ঢাকা
থেকে অনেক দুরের শান্ত গ্রাম থেকে স্বপ্ন চোখে ঢাকায় এসেছিল তিথি। তার ছোট্ট
সংসারে মা-বাবা আর তিন ভাইবোন। বাবার শরীরটা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল, তাই সংসারের
হাল ধরতে তিথি একটি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। শহরের ব্যস্ত জীবন আর গার্মেন্টসের
দমবন্ধ করা পরিবেশে তিথির মন খারাপ থাকত, তবুও পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সব
কষ্ট সহ্য করত।
তিথি ছিল শ্যামলা বর্ণের মিষ্টি
চেহারার একটি মেয়ে। তার সরলতা আর অমায়িক ব্যবহার খুব সহজেই মানুষের মন জয় করে নিত।
কিন্তু এই গুণগুলোই কর্মক্ষেত্রে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। গার্মেন্টসের কিছু
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশেষ করে তার সরাসরি বস, প্রায়ই তাকে অকারণে ডেকে পাঠাতেন,
ব্যক্তিগত কাজের ফরমায়েশ করতেন। কখনও সরাসরি খারাপ কিছু না বললেও তাদের চোখের
দৃষ্টি এবং ইঙ্গিতে তিথি অস্বস্তি বোধ করত। তাদের হাসি এবং কথা বলার ধরনে একটা
কুৎসিত ইঙ্গিত থাকত, যা তিথির মনে ভয় আর বিতৃষ্ণা জাগাত।
একদিন রাতে কাজ শেষে যখন তিথি
ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরছিল, তখন তার বস তাকে ডেকে একটি জরুরি ফাইলের কথা বলে
ফ্যাক্টরির ভেতরে যেতে বলেন। ভেতরে গিয়ে তিথি বুঝতে পারে সেটি একটি অজুহাত ছিল। বস
দরজা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে আসেন এবং অশালীন প্রস্তাব দেন। তিথি স্তম্ভিত হয়ে
যায়, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে সেখান থেকে ছুটে
পালায় সে।
এই ঘটনার পর তিথি মানসিকভাবে
ভেঙে পড়ে। তার মনে হতে থাকে যেন তার সম্মান আর আত্মমর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সে
কাজে যেতে ভয় পায়, রাতে ঘুমাতে পারে না। তবুও, পরিবারের কথা ভেবে তাকে আবার কাজে
যেতে হয়।
কিন্তু এবার তিথি একা ছিল না। কারখানার
কয়েকজন সহকর্মী, যারা এর আগেও এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে বা শুনেছে, তারা তিথির
পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর মুখ বুজে সহ্য করবে না।
তারা গার্মেন্টসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে, যেখানে
তিথির সাথে ঘটা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয় এবং অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে হওয়া
হয়রানির কথাও উল্লেখ করা হয়।
প্রথমে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি
ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ এবং স্থানীয় কিছু
শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপে তারা বাধ্য হয় তদন্ত শুরু করতে। তদন্তে তিথির অভিযোগের
সত্যতা প্রমাণিত হয় এবং সেই লম্পট কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এই ঘটনা তিথির জীবনে একটি নতুন
মোড় আনে। সে বুঝতে পারে যে একা না থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করলে অন্যায়ের
বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। তার মনে সাহস জন্মায় এবং সে ভাবে, শুধু নিজের নয়, আরও
অনেক মেয়ের জন্য তাকে কিছু করতে হবে।
এরপর তিথি স্থানীয় একটি শ্রমিক শ্রমিক
সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। সেখানে সে অন্যান্য নারী শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে
সচেতন করতে শুরু করে। সে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেয় এবং নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা
অন্যদের সাথে ভাগ করে নেয়, যাতে তারা সাহস পায় এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে
আসে।
ধীরে ধীরে তিথি একজন সাহসী ও
স্পষ্টবাদী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। সে গার্মেন্টসে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন, কাজের
পরিবেশ এবং নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে।
তিথি বুঝতে পারে, শুধু
গার্মেন্টসে নয়, তার গ্রামের অন্যান্য মেয়েদেরও শিক্ষার অভাব এবং দারিদ্র্যের
কারণে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, ভবিষ্যতে সে তার
গ্রামে একটি ছোট স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে গরিব মেয়েরা বিনামূল্যে পড়াশোনা
করতে পারবে এবং আত্মনির্ভরশীল হতে শিখবে।
তিথি এখন আর সেই ভীত সন্ত্রস্ত
মেয়েটি নেই। কর্মক্ষেত্রে হওয়া ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাকে দুর্বল না করে বরং আরও
শক্তিশালী করেছে। সে এখন অনেক নারীর অনুপ্রেরণা, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়াতে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে সাহস যোগায়। তার ভবিষ্যৎ
পরিকল্পনা শুধু তার নিজের জন্য নয়, বরং তার সমাজের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া নারীদের
জন্য একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার আলো দেখায়। তিথি জানে, পথটা কঠিন, কিন্তু তার মনে যে
সাহস আর সংকল্পের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, তা একদিন নিশ্চয়ই একটি সুন্দর ভবিষ্যতের
বৃক্ষে পরিণত হবে।
লিখেছেনঃ
খাইরুল মামুন মিন্টু
আইন
বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র