Followers

Saturday, November 23, 2024

১২ বছরেও বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাইনি শ্রমিকরা

২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ড। শ্রমিক হত্যা দিবস, ১২ বছরেও বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাইনি শ্রমিকরা।

বাংলাদেশের ঢাকার মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সংঘটিত একটি মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড যাতে মোট ১১৭ জন পোষাক শ্রমিক নিহত হয় ও ২০০ জনের অধিক আহত হয়। ভয়ানক এই দুর্ঘটনায় ঐ পোশাক কারখানার ৯তলা ভবনের ৬তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়। সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোষাক শ্রমিক ও আগুন থেকে রেহাই পেতে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের। ২৭ নভেম্বর ২০১২, মঙ্গলবার বাংলাদেশে শোক দিবস পালিত হয়। এটি দেশের ইতিহাসে কারখানায় সবচেয়ে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। প্রাথমিকভাবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লেগেছিল বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু সংসদের এক আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এ ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে”। শ্রমিক সংগঠন গুলো মনে করে ইনস্যুরেন্স ও বায়ারদের কাছ থেকে সুবিধা নিতে মালিকপক্ষ পরিকল্পিতভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।

এই ঘটনা ও পরে অনুরূপ কিছু ঘটনার পর বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার ও নিরাপত্তা আইনগুলিতে নানাবিধ সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়। তাজরীন ফ্যাশন কারখানাটি ২০০৯ সালে চালু হয়। এখানে প্রায় ১৬৩০ জন শ্রমিক কাজ করত। কারখানাটি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি টি-শার্ট, পোলো শার্ট এবং জ্যাকেট তৈরি করত, যাদের মধ্যে রয়েছে মার্কিন মেরিনস, ওলন্দাজ কোম্পানি সি এন্ড এ, মার্কিন কোম্পানি ওয়ালমার্ট এবং হংকং-ভিত্তিক কোম্পানি লি অ্যান্ড ফুং। এই কারখানাটি বাংলাদেশের অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তুবা গ্রুপের অংশ ছিল যারা জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডে পোশাক রপ্তানি করত। এর প্রধান খদ্দের ছিল ওয়ালমার্ট, কারেফোর এবং আইকিয়া। তাজরিন ফ্যাশনসের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০১১ সালের মে মাসে ওয়ালমার্টের একজন এথিকাল সোর্সিং অফিসার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয় এমন পরিস্থিতি রয়েছে এবং/অথবা লঙ্ঘন করেছে মর্মে কমলা গ্রেড দিয়ে কারখানাটি পতাকাঙ্কিত করেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ২ বছর মেয়াদে ৩টি কমলা গ্রেড মূল্যায়ন পাওয়া যে কোন কারখানা এক বছরের জন্য ওয়ালমার্ট থেকে কোন অর্ডার পাবে না। কোম্পানিটি কমলা রেটিং এই প্রথম পায়, ও পরের আগস্টে হলুদ মাঝারি ঝুঁকির রেটিং পায় (যেখানে আগুন লাগে সেটি তার অংশ ছিল)।

২৫ নভেম্বর ওয়ালমার্টের একজন মুখপাত্র বলেন যে তিনি এটা নিশ্চিত করতে পারছেন না যে তাজরিন ওয়ালমার্টের সরবরাহকারী কিনা এবং নিবন্ধে উল্লেখিত নথিটি আসলে ওয়ালমার্ট থেকে পাওয়া কিনা পরে কোম্পানিটি তাজরিনের সাথে তার সম্পর্কের ইতি টানে ও জানায় যে [আশুলিয়াতে] তাজরিন কারখানাটি ওয়ালমার্টের পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করার জন্য অনুমোদিত নয়। অনুমোদন ছাড়া [তাঁদের] এক সরবরাহকারী এই কারখানাতে কাজের অধীনচুক্তি (সাবকনট্রাক্ট) করে এবং এটি আমাদের নীতির সরাসরি লঙ্ঘন। ওয়ালমার্ট সমালোচকরা দাবি করে যে ওয়ালমার্ট কোম্পানিটির অনিরাপদ অবস্থার বিষয়ে জানত এবং অবস্থা উন্নত করার প্রচেষ্টাগুলি বন্ধ করে দেয়। ইমেলের মাধ্যমে পাওয়া নথিগুলিতে দেখা যায় যে তাজরিন কারখানার মাধ্যমে ওয়ালমার্ট একাধিক পোশাক উৎপাদনের আদেশের অধীনচুক্তি করেছিল। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ২০১১ সালের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে কারখানার বৈদ্যুতিক ও অগ্নি নিরাপত্তার জন্য বাড়তি অর্থ আদায়ের প্রস্তাবে ওয়ালমার্টের প্রতিনিধি আপত্তি জানিয়েছিলেন।

ওয়ালমার্টের পরিচালক শ্রীদেবী কালাভাকোলানু বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৪৫০০ পোশাক কারখানার বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে বিশাল ও ব্যয়বহুলও এই পরিমাণ বিনিয়োগ করা ব্র্যান্ডগুলোর জন্য আর্থিকভাবে বাস্তবসম্মত নয়। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করে হয়। সন্ধ্যায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে আগুন লাগে। ৯তলা ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে মুহূর্তেই আগুনের ধোঁয়া ও শিখা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। যার কারণে ভবনের উপরের তলার শ্রমিকরা আটকা পড়ে যান। কারখানার বৃহৎ পরিমাণে ফ্যাব্রিক এবং সুতা থাকার কারণে, আগুন দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে, যা অগ্নিনির্বাপকের কাজকে জটিল করে। পরদিন রবিবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ৯ তলা ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সবচেয়ে বেশি ৬৯ টি লাশ উদ্ধার করা হয়, চতুর্থ তলায় ২১ এবং পঞ্চম তলায় ১০টি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় যে অনেক শ্রমিক ভবনের সংকীর্ণ প্রস্থানের পথ দিয়ে নিচে নামতে পারছিলেন না। প্রাণে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে মারা যায় ১২ জন শ্রমিক, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে আহতবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মারা যান। কিছু শ্রমিক ভবনটির ছাঁদে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন যাদের পরে সফলভাবে উদ্ধার করা হয়। দমকল বাহিনীর অপারেশন ব্যবস্থাপক মো. মাহবুব জানান, কারখানাটিতে পর্যাপ্ত জরুরি প্রস্থানের অভাব ছিল যা দিয়ে দিয়ে ভবন থেকে নামা যেত। ভবনে ৩টি সিঁড়ি ছিল, যেগুলির সবগুলি নিচতলায় এসে মিলিত হয়। নিচ তলায় আগুন লাগার কারণে এগুলি ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠে। এতে অনেক শ্রমিক আটকা পড়েন এবং আগুন থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না। এই ঘটনায় ঘটনাস্থলে শ্রমিকদের আত্মীয় স্বজন ও হাজার হাজার প্রত্যক্ষদর্শী জড়ো হয়।

পরে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সেনা মোতায়েন করা হয়। অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। তিনি সন্দেহ করেন যে পরিকল্পিতভাবে অগ্নি অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা করে অর্থসহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তাজরিন ফ্যাশনের অন্যতম ক্রেতা প্রতিষ্ঠান হংকংভিত্তিক লিং অ্যান্ড ফাং এই ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে ও জানায় তারা নিজেদের উদ্যোগে আগুনের ঘটনার কারণ তদন্ত করে দেখবে। তাজরিন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ার হোসেন কারখানার কাজের পরিবেশ ভালো ছিলো বলে দাবি করেন ও বলেন যে এটা আমার কর্মীদের এবং আমার কারখানা জন্য একটি বিশাল ক্ষতি। আমার ৭টি কারখানার মধ্যে এই প্রথম কোন কারখানায় আগুন লাগল। তদন্তকারীরা জানায় ২০১২ সালের জুনে কারখানার আগুনের নিরাপত্তার সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফৌজদারি অবহেলার অভিযোগে ২৮ নভেম্বর কারখানার তিনজন তত্ত্বাবধায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। বের হওয়ার পথে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে বাধা দেয়ার অভিযোগে পুলিশ তাদের অভিযুক্ত করে।

দ্বিতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে বেঁচে যাওয়া এক শ্রমিক মোহাম্মদ রিপু জানান, কারখানা ব্যবস্থাপক তাদেরকে বলেছিলেন, আগুন লাগার এলার্ম নষ্ট হয়ে গেছে। কাজ ফিরে যাও।এই ঘটনার পর হাজার হাজার বাংলাদেশী গার্মেন্টস কর্মী বিক্ষোভ মিছিল করে, কর্মসংস্থানে নিরাপত্তার জন্য আহ্বান জানান। এই বিক্ষোভ তিন দিন ধরে চলে এবং একটি প্রধান মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা। বিক্ষভের সময় দুই শতাধিক কারখানার মালিক তাদের ফটকে তালা লাগিয়ে দেয়। কারখানার মালিকরা কারখানার অভ্যন্তরীণ সরঞ্জামগুলি রক্ষা করতে তালা লাগিয়েছেন জানান। এছাড়া, সরকার নিহতদের স্মরণে ২৭ নভেম্বর ২০১২ তারিখে জাতীয় শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়।

২৭ নভেম্বর, ওয়ালমার্ট আমেরিকা তুবা কোম্পানির সাথে চুক্তি বাতিল করে, ওয়ালমার্ট জানায় যে তাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাদের অনুমোদন ছাড়াই তাজরিন ফ্যাশনসকে পোশাক তৈরি করতে দেয়ার চুক্তি করেছে। ওয়ালমার্টের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “এই ঘটনা আমাদের জন্য চরম বিব্রতকর। অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান উন্নয়নে আমরা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কাজ করে যাবো।” ওয়ালমার্ট আরও বলে যে তারা ইনস্টিটিউট ফর সাসটেনেবল কমুনিটিজকে এক দশমিক ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করবে, যারা বাংলাদেশে পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা একাডেমী প্রতিষ্ঠার জন্য দান ব্যবহার করবে। শ্রমিক অধিকার সংঘের নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভা বলেন, দানটি শিল্পকে নিরাপদ করার জন্য খুব কম, বিশেষ করে যেহেতু বেশিরভাগ কারখানায় অগ্নিনির্বাপকের মতো মৌলিক নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলি নেই। ১৫ মে ২০১৩ সালে, যেসব কোম্পানির পোশাক তাজরিন ডিজাইন লিমিটেডের কারখানাতে তৈরি হয়েছিল তারা আগুনের ক্ষতিগ্রস্থের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে জেনেভাতে এক বৈঠকে বসেন; ওয়ালমার্ট ও সিয়ার্স অজানা কারণে সভায় তাদের প্রতিনিধিদের পাঠাতে অস্বীকার করে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি নিরাপত্তা ও শ্রম মানদণ্ডের পালন না করার কারণে ৮৫০টি কারখানাকে তাদের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভের সদস্যরা মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের কার্যালয়কে জিএসপির জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার পর্যালোচনা সম্পূর্ণ করতে আহ্বান জানায়। এই ভয়াবহ অগ্নিঘটনার কারণ নিরূপণ করতে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ৪ দফা তদন্তের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর এবং বাংলাদেশ পুলিশ -সরকারের এই চারটি অঙ্গ পৃথক পৃথক তদন্ত কার্যক্রম গ্রহণ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে ‘আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশন লিমিটিড এ সংঘটিত মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন’ শিরোনামে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

 প্রতিবেদনে তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেড এর মালিককে দণ্ড-বিধির তিন শত চার (ক) ধারায় আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করা হয়। তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম একটি মামলা করেন। অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পর ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পুলিশ তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেফতারের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত।

২০১৯ অনুযায়ী ১০৪ সাক্ষীর মধ্যে ৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে, ৩টি নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ দল, বাংলাদেশে অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি, অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি এবং ন্যাশনাল ট্রিপার্টাইট অ্যাকশন প্ল্যান, বস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলির জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মানের একটি নতুন একীভূত সেট গ্রহণে সম্মত হয়। কারখানা ও শ্রমিক কল্যাণ বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে ওয়াল-মার্ট এবং গ্যাপ ইনকর্পোরেটেডের ২৪টি মার্কিন কোম্পানি একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। মামলার সুরাহা হয়নি ১২ বছরেও। অথচ এই দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেলোয়ার হোসেনকে সভাপতি ও আবদুল জলিলকে সাধারণ সম্পাদক চূড়ান্ত করা হয়। ২০১৮ সালে রাজনীতি শুরু করেছেন দেলোয়ার। সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতে টাকার বিনিময়ে নেতৃত্বের পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন অথচ খুনের মামলার বিচার শেষ হয়নি। ২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পরপরই কারখানার তৃতীয় তলার ফটকে তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল।

এতে ১১৭ জন শ্রমিক নিহত হন। অগ্নিদুর্ঘটনার পরের বছর সিআইডি অভিযোগপত্র দেয়। আসামিরা হলেন তাজরীনের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলামসহ ১৩ জন। বর্তমানে আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। মামলার সাক্ষী ১০৪ জন। তাজরীনের ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির এমডিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। তবে সাক্ষী হাজির না করতে পেরে বারবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।

শেখ হাসিনা সরকার বিদায় নেওয়ার মধ্যো দিয়ে এখন সুযোগ এসেছে এই হত্যা কান্ডের বিচার করার। তাজরিন গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক হত্যা কান্ডে এমন একটা বিচার করতে হবে যাতে গার্মেন্টস মালিকরা কোন কারখানায় এই ধরনের শ্রমিক হত্যা কান্ড ঘটাতে না পারে। প্রতিটি কারখানা যাতে নিরাপদ কর্মস্থল হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তাজরীন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ারসহ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিহত শ্রমিকদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য আজীবন আয়ের মানদণ্ডে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

Tuesday, November 5, 2024

গার্মেন্ট শ্রমিকরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হলেও শ্রমিকদের সাথে বৈষম্য দূর হয়নি।

 

বাংলাদেশে শ্রমিকদের আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরানো হলেও শ্রমিকদের সাথে যে বৈষম্য করা হয় তা সমাধান হয়নি। বিগত শেখ হাসিনা সরকার শ্রমিকদের নানান প্রতিস্ত্রতি দেওয়া হলেও বাস্তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি বরং শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবীতে আন্দোলন করলে শ্রমিকদের উপর গুলি করে হত্যা, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শ্রমিকদের উপর হামলা- শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করা সহ নানান নির্যাতন । বিগত খালেদা জিয়া সরকারের সময় ২০০৬ সালে গার্মেন্ট শিল্পে সব থেকে বড় বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে সরকারকে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন ও শ্রম আইন-প্রণোয়নে বাধ্য হয়। সে সময় বিএনপি সরকার শ্রমিকদের উপর গুলি করে হত্যা, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শ্রমিকদের উপর হামলা- শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করা সহ নানান নির্যাতন চালাই।

তার মানে বার বার সরকার বদল হলেও শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শ্রমিকদের উপর হামলা- শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করা সহ নানান নির্যাতন করা বন্ধ হয়নি।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বাঁচার মত আদর্শ ন্যুনতম মজুরি দাবী জানিয়ে আসলেও তা পাইনি সর্বশেষ গত বছর ২০২৩ সালে গার্মেন্ট শ্রমিকরা ন্যুনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা দাবী জানালেও ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারন করা হয়। শ্রমিকরা বারবার মজুরি বৃদ্ধি, রেসনিং ব্যবস্থা চালুর দাবী জানিয়ে আসলেও শ্রমিকরা বাঁচার মত আদর্শ ন্যুনতম মজুরি পাইনি এবং রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়নি। পোশাক মালিকদের বিত্ত আর জীবনযাপন দেখলে মনে হয় না যে ব্যবসা খারাপ। ২০২২ সালেও ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা। সেই ডলারের দর এখন ১২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলার রপ্তানি আয়ে আগের চেয়ে তাঁরা বেশি পেয়েছেন ৩৬ টাকা। তা ছাড়া উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়াও দরকার। সর্বনিম্ন মজুরি দিয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা পাওয়া যাবে না। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে।

সরকার আসে সরকার যায় শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়না। সরকারে যেই আশুক ঘুরে ফিরে সরকারে মালিকদের প্রভাব বেশি থাকে। সরকার গুলো মালিকদের খপ্পর থেকে বের হতে পারেন না।

সম্প্রতিক আশুলিয়া-গাজীপুর সহ বিভিন্ন গার্মেন্ট  শিল্প অঞ্চলে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ, চাকুরীর নিশ্চয়তা, প্রডাকশনের চাপ কমানো, শ্রমিক ছাঁটায় বন্ধ সহ শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবী নিয়ে গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা এবং চাকুরী প্রত্যাশী শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন।

কয়েকটি কারখানার মালিক শ্রমিকদের দাবীর বিষয় সমাধান করলেও শিল্পাঞ্চলে আন্দোলন থামেনি বরং দিনে দিনে আন্দোলন ছড়িয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো আন্দোলন কেন ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস এর পর থেকে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছ প্রায় দিগুন থেকে তিন গুন। ঘর ভাড়া, জীবন যাত্রার ব্যয় সব কিছু বেড়েছে। যার কারণে শ্রমিকরা যা বেতন পাই তা দিয়ে শ্রমিকদের একার পক্ষে চাকুরী করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারণ করা সম্ভব হচ্ছেনা। যার কারণে স্বামী-স্ত্রী বা নারী-পুরুষ সমান ভাবে কাজ করতে চান।

কারখানার প্রকার ভেদ যদি ধরা হয় তাহলে গার্মেন্ট বলতে আমরা বুঝি,ওভেন, ডেনিম, নিটিং আবার নিটিং এর মধ্যে দুই রকম একটা গেঞ্জি নিটিং আরেকটি সোয়েটার্স নিটিং। আরেকটি কারখানার প্রকার হলো ট্রেক্সটাইল এর টেক্সটাইলের সাথে যুক্ত কারখানার হলো, স্প্লিং, ডাইনিং, ওয়াশিং। এই সবগুলো কারখানা গার্মেন্ট এর সাপ্লায়ের সাথে যুক্ত।

কারখানার প্রকার ও কারখানায় কাজের লাইন ভেদে নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেন মালিকরা। কোন জায়গায় নারী বেশী আবার কোন জায়গায় পুরুষ বেশী। যার কারণে গড় করলে নারী-পুরুষ শ্রমিকের খুব বেশী পার্থক্য নেই।  তবে গার্মেন্ট কারখানার ওভেন, ডেনিম, গেঞ্জি নিটিং এর সব থেকে বড় বিভাগ হলো সুইং সেখানে কাজ করে বেশীর ভাগ নারী শ্রমিক। কারখানার গেইটে নারী ও পুরুষ শ্রমিক দুজন যদি চাকুরীর প্রত্যাশায় আসে তাহলে গার্মেন্ট মালিকরা নারী শ্রমিককে নিয়োগ দেন।

যার কারণে দেখা যাচ্ছে পুরুষ শ্রমিক চাকুরী না পেয়ে বেকার থাকতে হচ্ছে এবং তার স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভর থাকতে হচ্ছে। তার স্ত্রী একা যে বেতন পাচ্ছে তা দিয়ে পারিবারিক ব্যয় মিটাতে পারছেন না, অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ অশান্তি দেখা দিচ্ছে। পুরুষ শ্রমিক বেকার থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাকে ঘর ঝাড়ু দেওয়া, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা সামলানোসহ অনেক ঘরের কাজ করতে হচ্ছে যা সে মনে করছে তার জন্য অসম্মানের।

যার কারনে পুরুষ শ্রমিকরা চাকুরী চেয়ে কারখানার গেইটে বিক্ষোভ করছেন এবং তাদের বিক্ষোভে সমর্থন দিচ্ছে কারখানার ভিতরে থাকা নারী-পুরুষ উভয় শ্রমিকরা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কারখানায় না পূরণ হওয়া দাবী, অতিরিক্ত প্রডাকশনের চাপ, কথায় কথায় চাকুরিচ্যুত করা এবং কর্মকর্তাদের খারাপ আচরণ। এর পাশাপাশি মালিকদের নেতৃত্বের দন্দ, ঝুট ব্যবসার ভাগাভাগি এবং কিছু সুযোগ সন্ধানি লুটপাট কারী যারা শ্রমিকদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে কারখানায় লুটপাট করেন। সব মিলিয়ে শ্রমিকদের এই আন্দোলন।

কারখানায় নিয়োগে নারী-পুরুষের নিয়োগে সমতা নিশ্চিত করা এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তা উল্লেখ করা। শ্রমিকদের জীবন মান অনুযায়ী বেতন পুন-নির্ধারিন করা। শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা। প্রডাকশনের চাপ কমানো। শ্রমিক ছাঁটায়-নির্যাতন বন্ধ করে চাকুরীর নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা। বিজিএমইএ এর শ্রমিকদের তথ্য ভান্ডারে শ্রমিকদের নামে নিতিবাচক বক্তব্য লিখে কালো তালিকা করা বন্ধ করতে হবে। কারখানায় কারখানায় শ্রমিকদের সমস্যা গুলো চিহ্নিত করে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে সমাধান করা। ঝুট ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। গার্মেন্ট মালিকরা নিজেদের মধ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য না দেওয়া। শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা বাড়ানো।

আমরা দেখছি শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান না করে মালিকরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আনছেন। শ্রমিকরা তাদের দাবী নিয়ে আন্দোলন করলে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা আগেও বলা হতো এখনো তাইই বলা হচ্ছে। অথচ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা একেবারেই কম না। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেমন ছাত্ররা জীবন দিয়েছে তেমনি শ্রমিকরাও জীবন দিয়েছে অথচ শ্রমকিদের অবদানের কথা কোথাও স্বীকার করা হচ্ছেনা। শ্রমিকরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হছিল তাদের সাথে যে বৈষম্য করা হচ্ছে তা দুরকরার জন্য কিন্তু সেই বৈষম্য কি দূর হবে?    

ইতি মধ্যে বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের নামের তালিকা কারখানার নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশুলিয়া এলাকায় বিভিন্ন কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর টঙ্গাবাড়ির ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড নামের একটি কারখানায় কাওসার নামের এক জন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মাসকট গার্মেন্টসের সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর রোকেয়া বেগম নামের এক নারী শ্রমিক দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে নিহত হয়েছে। বহু শ্রমিক গুলি বিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে এবং অনেক শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকার জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন বকেয়া রেখে কারখানা বন্ধ করে রেখেছে মালিকপক্ষ। সরকারী ও বিজিএমইএ এর বিভিন্ন পর্যায় থেকে দফায় দফায় শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ এর আশ্বাস দিয়েও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। শ্রমিকরা গত ২৩ অক্টোবর বকেয়া বেতনের দাবীতে শান্তিপূর্ন ভাবে বিক্ষোভ করলে শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে লাঠি চার্জ ও গুলি চালানো হয়। বহু শ্রমিক আহত হয় এবং চার জন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয় তার মধ্যে একজন নারী শ্রমিক চম্পা খাতুন গত ২৭ অক্টোবর ২০২৪ সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

কার্ল মার্কস ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন শ্রমিকরা যখন নিজের দাবি-দাওয়া আদায়ে সোচ্চার হবে তখনই পুঁজিবাদের ভিত নড়ে উঠবে। পুঁজিবাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সেই আশা পুরোটা বাস্তবায়িত না হলেও তার চিন্তা যে ভিত্তিহীন ছিল না তা আজ স্পষ্ট। বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট এর লড়াইয়ের বিজয় বাংলাদেশতো বটেই অন্যান্য দেশের জনগণকেও নতুন সংগ্রামের পথ দেখিয়েছে। সমগ্র মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে, জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শক্তি যেকোনো রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী। আমাদের দেশের একটি বৃহত্তম রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। মোটা অঙ্কের বৈদেশিক আয় অর্জিত হয় এই খাত থেকে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই আয় তাদের জীবনের মূল্যমান বড়োজোর দুই লাখ টাকা। শ্রমিকদের জীবনযাপন যে কতোটা মানবেতন তা খোলা চোখ থাকলে অবশ্যই দেখা সম্ভব। অথচ মালিকপক্ষ তাদেরকে দিয়ে যন্ত্রের মতো দিনরাত পরিশ্রম করিয়ে মুনাফার অট্টালিকা গড়ে তুলছে।

দীর্ঘ ৪৫ বছরে এত কিছু হলেও কেবল একটি জিনিসই বদলায়নি। আর তা হলো পোশাক মালিকদের আচরণ ও মনোভাব। এখনো পোশাক খাত পরিচালিত হয় সনাতন কায়দায়। ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন দমনই কেবল শিখেছে এই খাতের সংশ্লিষ্টরা। রাজনৈতিকভাবে পোশাক মালিকেরা এখন এতটাই প্রভাবশালী, যেকোনো সিদ্ধান্ত নিজেদের স্বপক্ষে আনতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না।

গত ৪৫ বছরে বিজিএমইএ একটি কাজই ভালোভাবে শিখেছে, আর তা হলো সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আন্দোলন দমন, মজুরির দাবি যতটা কম রাখা যায় তার ব্যবস্থা করা এবং সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায়। তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকেন কিছু শ্রমিকনেতাও। যারা অর্থের বিনিময়ে মালিকদের সমর্থন করেন। বিশেষ করে মজুরিকাঠামো চূড়ান্ত করা এবং আন্দোলন দমন করার ক্ষেত্রে এমনটা বেশি ঘটেছে।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পরে আন্তর্জাতিক চাপে পোশাক খাতে শ্রমিক ইউনিয়ন ব্যবস্থা চালু রাখতে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া শিথিল করা হয়। এখন পর্যন্ত এই শিল্পে নিবন্ধিত আছে ১৩০০ শ্রমিক ইউনিয়ন। বাকি ৭০ শতাংশ কারখানায় আছে অংশগ্রহণ কমিটি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ইউনিয়ন বা কমিটির নেতৃত্বে আছেন মালিকপক্ষের অনুগতরা। আর যাঁরা অনুগত নন, প্রতিটি আন্দোলনের পরে তাঁরা নানা হয়রানির মুখে পড়েন।

শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে দাবি আদায়ে আরও অনেকের মতো আন্দোলনে নেমেছেন পোশাকশ্রমিকেরা। তবে অন্য সবাই কাজে ফিরে গেলেও অস্থিরতা রয়ে গেছে পোশাক খাতে। কারণ, এখন আর গোয়েন্দা সংস্থা বা শিল্প পুলিশ দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন থামাতে পারছে না মালিকপক্ষ। এ অবস্থায় দাবি দাওয়া জানানোর জন্য যেমন একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায় বের করতে হবে, তেমনি তৈরি করতে হবে দাবি পূরণের আলোচনার পথ অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার। আর যেকোনো আন্দোলন হলেই বাইরের ষড়যন্ত্র, বিদেশি ইন্ধন-এসব বলাও বন্ধ করা প্রয়োজন।

পুঁজিবাদীদের শোষণ-শাসনের মুক্তির জন্য শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনায় শানিত হয়ে দেশে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে শোষক বুর্জোয়া শ্রেণির বিকল্প বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন দেশে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব করেছে। পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনের নিষ্ঠুর জাঁতাকল ভেঙে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলছে।

শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক এ সংগ্রামে ব্যর্থতা ও বিপর্যয় আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ একবিংশ শতাব্দীতেও শ্রমিক শ্রেণির এই বৈপ্লবিক সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়া ও তাকে বিজয়ী করা ছাড়া মানবজাতির মুক্তির আর কোনো পথ নেই। বাংলাদেশেও শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে এ সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া ছাড়া বাংলাদেশ ও তার শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের মুক্তি নেই। এ সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণি শুধু নিজেকে মুক্ত করবে না, মুক্ত করবে বঞ্চিত-অবদমিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত, অবরুদ্ধ-অচলায়তনের গোটা সমাজকে।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

Thursday, October 3, 2024

গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতার জন্য গার্মেন্ট মালিকরাই দায়ী

 

সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই এবং ডিইপিজেড নিয়ে এই শিল্প জনে প্রায় চৌদ্দ থেকে পনের শত গার্মেন্ট কারখানা আছে যার মধ্যে পনের থেকে বিশটি গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবীতে কর্মবিরতি পালন করছেন। যা পার্সেন্ট করলে হয় মাত্র এক থেকে দুই পার্সেন্ট।

তাহলে আমার কথা হলো মাত্র এক থেকে দুই পার্সেন্ট কারখানায় এই আন্দোলন কেন? এবং বারবার বিজিএমই’তে আলোচনা হলেও এই কারখানা গুলোতে সমাধান হচ্ছে না কেন?

আশুলিয়াতে পনের আগস্টের পরে ডিইপিজেড এর গেইটে চাকুরীপ্রত্যাশী ও বহিরাগতরা প্রথম আন্দোলন করে এবং তা কিছুদিন পর নিয়ন্ত্রণে আসে। পরবর্তীতে পঁচিশ আগস্ট ডিইপিজেড এর বাইরের কারখানা ডংলিয়ন নামের একটি কারখানায় আন্দোলন হয় এবং ছাব্বিশ আগস্ট শ্রমিকদের দাবী মেনে নেওয়ার কারনে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যায়। এবং এই আন্দোলনের পর পর্যায় ক্রমে বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যা এখন নিয়ন্ত্রণে।

বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্ট মালিকদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তারা সমাধান চান না বরং সমস্যা জিইয়ে রাখতে চান। কারখানার মালিকরা যে শ্রমিকদের সমস্যার কথা শুনতে বা বুঝতে চান না। তারা চান ১৩/১ ধারায় কারখানা বন্ধ করে সমস্যা জিইয়ে রেখে শ্রমিকদের নামে মামলা দিয়ে কিছু শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করতে কিন্তু বর্তমান সরকার তা হতে দিতে চাচ্ছেন না। এই জন্য কিছু মালিক বর্তমান সরকারের উপর ক্ষুব্ধ।

বাস্তবতা হলো, কারখানা মালিকদের ২০২৪ সালের কাজের যে তার্গেট ছিল তা শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করিয়ে পূরণ করে ফেলেছেন। অর্থাৎ এক বছরের কাজ তারা শ্রমিকদের দিয়ে আট মাসেই করিয়ে নিয়েছেন। এখন কিছু গার্মেন্ট মালিকরা চাচ্ছেন কারখানায় কিছু শ্রমিক কমিয়ে আনতে। কিন্তু শ্রমিক কমিয়ে আনতে হলে শ্রম আইনের ২৬ ধারা অথবা ২০ ধারায় করতে হবে যেখানে শ্রমিকদের আইনগত পাওনার বিষয়টা চলে আসে কিন্তু যদি ১৩/১ ধারায় কারখানা বন্ধ করে সমস্যা জিইয়ে রেখে শ্রমিকদের নামে মামলা দিয়ে কিছু শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা যায় তাহলে বিজিএমইএর আরবিটিশনে আলোচনা করে শ্রমিকদের লামসাম পাওনা দিয়ে বিদায় দেওয়া যাবে। ইতি মধ্যে বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের নামের তালিকা কারখানার নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশুলিয়া এলাকায় বিভিন্ন কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর টঙ্গাবাড়ির ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড নামের একটি কারখানায় কাওসার নামের এক জন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মাসকট গার্মেন্টসের সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর রোকেয়া বেগম নামের এক নারী শ্রমিক দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে নিহত হয়েছে। বহু শ্রমিক গুলি বিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে এবং অনেক শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গার্মেন্ট মালিকরা প্রতিবছরের এই সময়ে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি এই চার মাসে একি কাজ করেন। প্রায় ৫ থেকে ১৫ শতাংশ শ্রমিকদের চাকুরীচ্যুত করেন। শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করার জন্য তিন ধরনের শ্রমিককে তার্গেট করা হয়। প্রথম তার্গেট করা হয় যে সব শ্রমিকরা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে চাই এবং বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলেন বা প্রতিবাদী শ্রমিক। দ্বিতীয় টার্গেট করা হয় যেসব শ্রমিকদের বয়স ৩৫ পার হয়েছে বা যাদের শারীরিক কাজের সক্ষমতা কমে গিয়েছেন। তৃতীয়ত তার্গেট করা হয় যাদের কারখানায় চাকুরীর বয়স এক বছরের নিচে।

প্রাশ্ন হলো এই সময়ে কেন শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করেন?

১। বড়দিন বা খ্রিস্টমাস বা ক্রিসমাস একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। যার কারনে বড়দিন বা খ্রিস্টমাস বা ক্রিসমাস একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসবের আগেই ব্যান্ড গুলো তাদের দোকানে বা আউটলেটে প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শুরুতেই নতুন নতুন পোশাক উঠাতে হয়। ব্যান্ড গুলো পোশাক উৎপাদন দেশ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই শিপমেন্ট করতে হয়। এবং ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যান্ড গুলোর কর্মকর্তারা ছুটিতে থাকেন অথবা এই সময়ে তারা যোগাযোগ বা পোশাক উৎপাদনের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন না। এই সময় তারা পরিবারের সাথে বড়দিন বা খ্রিস্টমাস বা ক্রিসমাস একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব পালন করেন।

২। শ্রম আইন অনুয়ারি গার্মেন্ট শ্রমিকদের প্রতি ৫ বছর পর পর মজুরি বৃদ্ধি বা নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয় এবং এই ৫ বছরে ৪ বার বেসিকের ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধি হয়। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে  গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি সাথে সমন্বয় করে প্রডাকশনের চাপ বা তার্গেট বাড়িয়ে দেন। ৫ থেকে ১৫ শতাংশ চাকুরিচ্যুত শ্রমিকদের প্রডাকশন যাতে কমে না যায় তার জন্য প্রতি ৫ বছরে এক জন শ্রমিকের কাছ থেকে পর্যায় ক্রমে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তি প্রডাকশন করিয়েনেন।

সরকারের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নেওয়ার টালবাহানা।

তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানিতে যেমন শীর্ষে তেমনি প্রণোদনা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানে তৈরি পোশাক। ১৯৮৬-৮৭ সময়ে সরকার চালু করে স্থানীয় ঋণপত্র বা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে রপ্তানি আয় আসার পরেই ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে হতো। পোশাক খাতের অগ্রগতির পেছনে এই দুই নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপরেও সরকার বিভিন্ন সময় নগদ সুবিধাসহ নানা ধরনের কর ছাড় দিয়েছে। আবার যেকোনো সংকটে পোশাকমালিকেরা সরকারের কাছে হাত পেতেছেন, সরকারও সব দাবি পূরণ করেছে।

বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই শিল্পের মালিকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজু হাতে প্রণোদনা নিয়েছেন। তেমনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছেও গার্মেন্ট মালিকরা প্রণোদনা প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সব গার্মেন্ট মালিক কি সুবিধা পাই?

গার্মেন্ট মালিকদের মধ্যে অনেক গুলো গ্রুপ আছে তার মধ্যে দুই গ্রুপ প্রকাশ্য এবং সক্রিয়। এক গ্রুপ আওয়ামী লীগ পন্থি আরেক গ্রুপ বিএনপি পন্থি। এই দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের প্রভাব আছে গার্মেন্ট শিল্পে। গত কিছু দিন আগে অনন্ত গ্রুপের মালিক ইনামুল হক খান (বাবলু) এর বক্তব্যে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়। তিনি বলেছেন গত নভেম্বর শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সময় তার একটি কারখানায় আগুন দেওয়া হয় এবং তার কয়েকটি কারখানায় ভাংচুর হয় কিন্তু তিনি বিজিএমইএর কাছে বিচার চেয়েছেন কিন্তু তখনকার আওয়ামী লীগ পন্থি বিজিএমইএর নেতারা কোন কথা শুনেন নি বরং তাকে ধমক দেওয়া হয়েছে। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ পন্থি বিজিএমইএর নেতারা পালাতক হয়ে যান। এবং আওয়ামী লীগ পন্থি গার্মেন্ট মালিকদের কারখানায় শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। যেমন আওয়ামী লীগ পন্থি মালিকদের কারখানা মন্ডল গ্রুপ, দি-রোজ ড্রেসেস, নাসা গ্রুপ, স্টারলিং গ্রুপ, হামিম গ্রুপ। এই কইটি কারখানা যে এলাকায় আছে ঠিক সেই এলাকায় তার্গেট করে আন্দোলন হচ্ছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে এবারের শ্রমিকদের আন্দোল্নে বিএনপি পন্থি মালিকদের হাত আছে।

গার্মেন্ট মালিকদের মায়া কান্না  

পোশাকমালিকেরা কখনোই মানতে চান না যে ব্যবসা ভালো চলছে। পোশাকমালিকদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করলেই তাঁরা বলেন, ব্যবসার অবস্থা খারাপ, অর্ডার কমে যাচ্ছে, ক্রেতারা কম দামে পোশাক কেনেন, উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে এবং এখানে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম।

অন্যদিকে পোশাক মালিকদের বিত্ত আর জীবনযাপন দেখলে মনে হয় না যে ব্যবসা খারাপ। ২০২২ সালেও ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা। সেই ডলারের দর এখন ১২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলার রপ্তানি আয়ে আগের চেয়ে তাঁরা বেশি পেয়েছেন ৩৬ টাকা। তা ছাড়া গত ৫ বছরে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এই উৎপাদনশীলতা আরো   বাড়াতে হলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সর্বনিম্ন মজুরি দিয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা পাওয়া যাবে না। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে।

তাই গার্মেন্ট সেক্টরে মালিকদের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ না করে ইচ্ছা কৃত ভাবে অস্থিরতার জন্য গার্মেন্ট মালিকরা জড়িত।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

Sunday, September 15, 2024

গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতার জন্য গার্মেন্ট মালিক জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা উচিৎ

 

সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই এবং ডিইপিজেড নিয়ে এই শিল্প জনে প্রায় চৌদ্দ থেকে পনের শত গার্মেন্ট কারখানা আছে যার মধ্যে পনের থেকে বিশটি গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবীতে কর্মবিরতি পালন করছেন। যা পার্সেন্ট করলে হয় মাত্র এক থেকে দুই পার্সেন্ট।

তাহলে আমার কথা হলো মাত্র এক থেকে দুই পার্সেন্ট কারখানায় এই আন্দোলন কেন? এবং বারবার বিজিএমই’তে আলোচনা হলেও এই কারখানা গুলোতে সমাধান হচ্ছে না কেন?

আশুলিয়াতে পনের আগস্টের পরে ডিইপিজেড এর গেইটে চাকুরীপ্রত্যাশী ও বহিরাগতরা প্রথম আন্দোলন করে এবং তা কিছুদিন পর নিয়ন্ত্রণে আসে। পরবর্তীতে পঁচিশ আগস্ট ডিইপিজেড এর বাইরের কারখানা ডংলিয়ন নামের একটি কারখানায় আন্দোলন হয় এবং ছাব্বিশ আগস্ট শ্রমিকদের দাবী মেনে নেওয়ার কারনে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যায়। এবং এই আন্দোলনের পর পর্যায় ক্রমে বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যা এখন নিয়ন্ত্রণে।

গতকালের বিজিএমইতে মতবিনিময় সভায় গার্মেন্ট মালিকদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে তারা সমাধান চান না বরং সমস্যা জিইয়ে রাখতে চান। কারখানার মালিকরা যে শ্রমিকদের সমস্যার কথা শুনতে বা বুঝতে চান না গতকালের আচরণে তা প্রমান হয়েছে। তারা চান ১৩/১ ধারায় কারখানা বন্ধ করে সমস্যা জিইয়ে রেখে শ্রমিকদের নামে মামলা দিয়ে কিছু শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করতে কিন্তু বর্তমান সরকার তা হতে দিতে চাচ্ছেন না। এই জন্য কিছু মালিক বর্তমান সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। তাই তারা গতকাল মতবিনিময় সভায় হট্টগোল করেছেন।

বাস্তবতা হলো, কারখানা মালিকদের ২০২৪ সালের কাজের যে তার্গেট ছিল তা শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করিয়ে পূরণ করে ফেলেছেন। অর্থাৎ এক বছরের কাজ তারা শ্রমিকদের দিয়ে আট মাসেই করিয়ে নিয়েছেন। এখন কিছু গার্মেন্ট মালিকরা চাচ্ছেন কারখানায় কিছু শ্রমিক কমিয়ে আনতে। কিন্তু শ্রমিক কমিয়ে আনতে হলে শ্রম আইনের ২৬ ধারা অথবা ২০ ধারায় করতে হবে যেখানে শ্রমিকদের আইনগত পাওনার বিষয়টা চলে আসে কিন্তু যদি ১৩/১ ধারায় কারখানা বন্ধ করে সমস্যা জিইয়ে রেখে শ্রমিকদের নামে মামলা দিয়ে কিছু শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা যায় তাহলে বিজিএমইএর আরবিটিশনে আলোচনা করে শ্রমিকদের লামসাম পাওনা দিয়ে বিদায় দেওয়া যাবে। ইতি মধ্যে বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের নামের তালিকা কারখানার নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গার্মেন্ট মালিকরা প্রতিবছরের এই সময়ে একি কাজ করেন। শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করার জন্য তিন ধরনের শ্রমিককে তার্গেট করা হয়। প্রথম তার্গেট করা হয় যে সব শ্রমিকরা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে চাই এবং বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলেন বা প্রতিবাদী শ্রমিক। দ্বিতীয় টার্গেট করা হয় যেসব শ্রমিকদের বয়স ৩৫ পার হয়েছে বা যাদের শারীরিক কাজের সক্ষমতা কমে গিয়েছেন। তৃতীয়ত তার্গেট করা হয় যাদের কারখানায় চাকুরীর বয়স এক বছরের নিচে।

তাই আমার মনে হয়েছে গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতার জন্য গার্মেন্ট মালিক জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা উচিৎ।  এবং পাশাপাশি মালিক-শ্রমিকের আন্তরিকতার কোন অভাব আছে কিনা তাও দেখা উচিৎ।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

Thursday, September 5, 2024

শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান না করে মালিকরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আনছেন।

সম্প্রতিক আশুলিয়া-গাজীপুর সহ বিভিন্ন গার্মেন্ট  শিল্প অঞ্চলে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ, চাকুরীর নিশ্চয়তা, প্রডাকশনের চাপ কমানো, শ্রমিক ছাঁটায় বন্ধ সহ শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবী নিয়ে গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা এবং চাকুরী প্রত্যাশী শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন

কয়েকটি কারখানার মালিক শ্রমিকদের দাবীর বিয়য় সমাধান করলেও শিল্পাঞ্চলে আন্দোলন থামেনি বরং দিনে দিনে আন্দোলন ছড়িয়ে যাচ্ছে

প্রশ্ন হলো আন্দোলন কেন ছড়িয়ে পড়ছে বিশেষ করে করোনাভাইরাস এর পর থেকে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছ প্রায় দিগুন থেকে তিন গুন ঘর ভাড়া, জীবন যাত্রার ব্যয় সব কিছু বেড়েছে যার কারণে শ্রমিকরা যা বেতন পাই তা দিয়ে শ্রমিকদের একার পক্ষে চাকুরী করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারণ করা সম্ভব হচ্ছেনা যার কারণে স্বামী-স্ত্রী বা নারী-পুরুষ সমান ভাবে কাজ করতে চান

কারখানার প্রকার ভেদ যদি ধরা হয় তাহলে গার্মেন্ট বলতে আমরা বুঝি,ওভেন, ডেনিম, নিটিং আবার নিটিং এর মধ্যে দুই রকম একটা গেঞ্জি নিটিং আরেকটি সোয়েটার্স নিটিং আরেকটি কারখানার প্রকার হলো ট্রেক্সটাইল এর টেক্সটাইলের সাথে যুক্ত কারখানার হলো, স্প্লিং, ডাইনিং, ওয়াশিং এই সবগুলো কারখানা গার্মেন্ট এর সাপ্লায়ের সাথে যুক্ত

কারখানার প্রকার ও কারখানায় কাজের লাইন ভেদে নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেন মালিকরা। কোন জায়গায় নারী বেশী আবার কোন জায়গায় পুরুষ বেশী। যার কারণে গড় করলে নারী-পুরুষ শ্রমিকের খুব বেশী পার্থক্য নেই।  তবে গার্মেন্ট কারখানার ওভেন, ডেনিম, গেঞ্জি নিটিং এর সব থেকে বড় বিভাগ হলো সুইং সেখানে কাজ করে বেশীর ভাগ নারী শ্রমিক। কারখানার গেইটে নারী ও পুরুষ শ্রমিক দুজন যদি চাকুরীর প্রত্যাশায় আসে তাহলে গার্মেন্ট মালিকরা নারী শ্রমিককে নিয়োগ দেন।

যার কারণে দেখা যাচ্ছে পুরুষ শ্রমিক চাকুরী না পেয়ে বেকার থাকতে হচ্ছে এবং তার স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভর থাকতে হচ্ছে। তার স্ত্রী একা যে বেতন পাচ্ছে তা দিয়ে পারিবারিক ব্যয় মিটাতে পারছেন না, অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ অশান্তি দেখা দিচ্ছে। পুরুষ শ্রমিক বেকার থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাকে ঘর ঝাড়ু দেওয়া, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা সামলানোসহ অনেক ঘরের কাজ করতে হচ্ছে যা সে মনে করছে তার জন্য অসম্মানের।

যার কারনে পুরুষ শ্রমিকরা চাকুরী চেয়ে কারখানার গেইটে বিক্ষোভ করছেন এবং তাদের বিক্ষোভে সমর্থন দিচ্ছে কারখানার ভিতরে থাকা নারী-পুরুষ উভয় শ্রমিকরা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কারখানায় না পূরণ হওয়া দাবী, অতিরিক্ত প্রডাকশনের চাপ, কথায় কথায় চাকুরিচ্যুত করা এবং কর্মকর্তাদের খারাপ আচরণ। এর পাশাপাশি মালিকদের নেতৃত্বের দন্দ, ঝুট ব্যবসার ভাগাভাগি এবং কিছু সুযোগ সন্ধানি লুটপাট কারী যারা শ্রমিকদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে কারখানায় লুটপাট করেন। সব মিলিয়ে শ্রমিকদের এই আন্দোলন।

শ্রমিকদের দাবী ও সমাধান

·        কারখানায় নিয়োগে নারী-পুরুষের নিয়োগে সমতা নিশ্চিত করা এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তা উল্লেখ করা।

·        শ্রমিকদের জীবন মান অনুযায়ী বেতন পুন-নির্ধারিন করা।

·        শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা।

·        প্রডাকশনের চাপ কমানো।

·        শ্রমিক ছাঁটায়-নির্যাতন বন্ধ করে চাকুরীর নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা।

·        বিজিএমইএ এর শ্রমিকদের তথ্য ভান্ডারে শ্রমিকদের নামে নিতিবাচক বক্তব্য লিখে কালো তালিকা করা বন্ধ করতে হবে।

·        কারখানায় কারখানায় শ্রমিকদের সমস্যা গুলো চিহ্নিত করে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে সমাধান করা।

·        ঝুট ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

·        গার্মেন্ট মালিকরা নিজেদের মধ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য না দেওয়া।

·        শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা বাড়ানো।

আমরা দেখছি শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান না করে মালিকরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আনছেন। শ্রমিকরা তাদের দাবী নিয়ে আন্দোলন করলে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা আগেও বলা হতো এখনো তাইই বলা হচ্ছে। অথচ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা একেবারেই কম না। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেমন ছাত্ররা জীবন দিয়েছে তেমনি শ্রমিকরাও জীবন দিয়েছে অথচ শ্রমকিদের অবদানের কথা কোথাও স্বীকার করা হচ্ছেনা। শ্রমিকরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হছিল তাদের সাথে যে বৈষম্য করা হচ্ছে তা দুরকরার জন্য কিন্তু সেই বৈষম্য কি দূর হবে?      

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

Monday, August 19, 2024

গার্মেন্ট কারখানায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে

 

কয়েকদিন ধরে ঢাকা ইপিজেড এর গেইটে কিছু চাকুরী প্রত্যাশী বেক্তি দাবী তুলেছেন যে, ঢাকা ইপিজেডের কারখানা গুলোতে নারী শ্রমিকের পরিবর্তে ৭০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে।

একসময় পোশাক খাতের মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী এবং ২০ শতাংশের কম ছিলেন পুরুষ শ্রমিক কিন্তু বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছেগবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি)র মতে, পোশাক খাতে নিযুক্ত মোট শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা কমে ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে এবং পুরুষ শ্রমিক বেড়ে ৪৩ শতাংশে।

অথচ একসময় পোশাক খাতের মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী। বিশেষ করে যারা গ্রামাঞ্চল থেকে রাজধানীতে এসে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করতেন তারা এই খাতে কাজ নিতেন।

দেশে অন্যান্য খাতে চাকরির সুযোগ খুব সীমিত থাকায় আশির দশকে মূলত অদক্ষ নারী শ্রমিকরা পোশাক খাতের হাল ধরেন। বছরের পর বছর ধরে নারী শ্রমিকদের অবদানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প। বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাকের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে।

তখন বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় অনেক কম হওয়ায় নারী শ্রমিকরা কম বেতন হলেও চাকরি নিতে আগ্রহী ছিলেন।

এরপর বহু বছর ধরে পোশাক খাতে পুরুষ শ্রমিকের বিপরীতে গড়ে অন্তত দুজন নারী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হতো।

তবে, সাম্প্রতিক সময়ে এই অনুপাত কমেছে। যার কারনে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এবং পুরুষ শ্রমিক বেড়ে ৪৩ শতাংশে।

তাই আমার মনে হয়েছে যেসব চাকুরী প্রত্যাশী বেক্তিরা দাবী তুলেছেন যে, ঢাকা ইপিজেডের কারখানা গুলোতে নারী শ্রমিকের পরিবর্তে ৭০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে। তারা আসলে নারীদের পিছিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। কারখানা গুলোতে শ্রমিকদের চাকুরী হওয়া উচিৎ দক্ষতা অনুযায়ী। নারী ও পুরুষ শ্রমিক এর যে যার যে দক্ষতা আছে তার সেই পদে চাকুরী হওয়া উচিৎ। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ এর বৈষম্য থাকা উচিৎ না।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা।

Thursday, August 15, 2024

মুক্ত বলতে যা বোঝায় তা কখনোই ছিলাম না, আগামীতেও হবো কি না?

 

বিভিন্ন জাতিসত্তা, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ সে রাষ্ট্রের নাগরিক অথচ অনেক স্বাধীন দেশের সব শ্রেণির মানুষ সমান স্বাধীন ও মুক্ত নয়। যেমন, ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম, কিন্তু তার সব নাগরিক স্বাধীন ও মুক্ত ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে আমরা কি তাহলে কারারুদ্ধ ছিলাম? না, তা-ও ছিলাম না। আমরা হাঁটা-চলাফেরা করেছি, হাটবাজার করেছি, কিন্তু মুক্ত বলতে যা বোঝায় তা ছিলাম না।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম, কিন্তু বাংলাদেশের সব নাগরিক স্বাধীন ও মুক্ত হয়েছে কি? মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্যতা পেয়েছে কি?

আমার মনে হয়েছে, হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ সেই গণতান্ত্রিক অধিকার চায়, যা তার ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য। যার জন্য আমরা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ অর্জন করেছি কিন্তু দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম পাওয়ার পরেও গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য এখন পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলছে।

অনেকে মনে করছেন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনাতার গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকার বিদায় নিয়েছে। তার মানে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায় হয়েছে। কিন্তু অতীত তা বলছে না। মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নিগ্রহ ও শোষণের ইতিহাস যার অন্য পিঠে ছিল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য।

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্যতা আদায় ও বৈষম্য দুরকরার জন্য আমরা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ অর্জন করেছি।

১৯৭১ সালের পরে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে সপরিবারে নিহত হন যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন।

১৯৮১ সালের ৩০শে মে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে নিয়ন্ত্রণ নেয় অভ্যুত্থানকারীরা।

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থান এর মাধ্যে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এই দিনে ভোরে দেশে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন জেনারেল এরশাদ।

টানা ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন জেনারেল এরশাদ। তাঁর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলাম, সিপিবিসহ সব দলকে আন্দোলন করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মুখে পতন হয় জেনারেল এরশাদের শাসনের।

তারপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং তারা দেশের উন্নয়নের কথা বলে বিভিন্ন কায়দা কানুন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে। সেই বার ২৮ অক্টোবর সামনে রেখে ঢাকা শহরে ছিল টানটান উত্তেজনা। আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং নেতাকর্মীদের লগিবৈঠা নিয়ে আসতে বলে। বিএনপি ওই দিন নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ও জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের কর্মসূচি নেয়। দুই পক্ষের রণপ্রস্তুতিতে সংঘাতের আশঙ্কা করা হয়েছিল।

এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর পুলিশ পল্টন ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় প্রায় ১৫ হাজারের মতো পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তারপরও সেদিন সংঘাত বন্ধ  ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও জামায়াতশিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় বায়তুল মোকাররম এলাকায়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ওই দিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ইস্তফাপত্র দেন।

ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা সৃষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি তত্ִকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষনা করেন। একই সাথে সেনা সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফখরুদ্দীন আহমেদকে নিয়োগ করা হয়। ফখরুদ্দিন আহমেদ ক্ষমতা গ্রহনের মধ্য দিয়ে ইতোপূর্বে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হয়। তিনি ২ বছর কেয়ার টেকার ছিলেন, ফখরুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব গ্রহনের পর তত্ִকালীন জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখার জন্য বেশ প্রশংসিত হন।

সে সময় বিশ্বের সর্বাধিক দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে ফখরুদ্দীন আহমেদ দূর্নীতিবিরোধী নানান কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সে সময় দেশের প্রায় ১৬০ জন রাজ্নীতিক, সরকারী কর্মকর্তা, নিরাপত্তা কর্মকর্তার নামে অর্থ আত্মসাত্ִ ও অন্যান্য দূর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়।এসময় দেশের ভূতপূর্ব দুই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ফখরুদ্দিন আহমেদ গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হয়।

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও জনতার ২৩ দিনের দেশ কাঁপানো আন্দোলনে শত শত মানুষের রক্তের বিনিময়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন শেখ হাসিনা। এরপর বঙ্গভবন থেকেই হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হলো।

গত ৮ আগস্ট ২০২৪, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার কত দিন থাকবে তা এখন পর্যন্ত ঠিক নেই। তবে এই কইদিনে আমার মনে হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের পথেই হাটছে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিরোধী মতের লোকদের গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের হয়রানি ও গণগ্রেফতার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব তৈরি করে, নির্বাচনী বিজয়, সহিংসতা এবং জরুরি ক্ষমতার সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করে। ইউরোপের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ফ্যাসিবাদী মডেলের উপর ভিত্তি করে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। একটি গণতান্ত্রিক সরকার মানে হলো জবাবদিহিমূলক সরকার। তারা সংবিধানিক প্রক্রিয়াকে অপব্যবহারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিকৃতি ঘটাতে পারবে, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবে।

ইতিহাসের অমোঘ সত্য হলো প্রত্যেক একনায়কই মনে করে যে তারা তাদের দেশে এক অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও শান্তি বয়ে আনতে পারবে, যদি শুধু তারা দেশের মধ্যে নাগরিক সমাজের বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর ও বিরোধীদের সমালোচনাকে থামিয়ে দেয়। শেখ হাসিনা প্রথম ও শেষ শাসক নন, যিনি এই মোহের ফাঁদে পড়েছিলেন। প্রত্যেক (স্বৈর) শাসকই উন্মাদনায় মেতে ওঠে আর শেষ পরিণতিতে সেনাবাহিনী অথবা উন্মত্ত জনতা শাসকের প্রাসাদ তছনছ করে দেয়।

উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করার কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু বাস্তবতা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আমি মনে করি কোনো দেশের রাস্তাঘাট, বড় বড় স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজন হয় না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে’ বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দেন এবং ভূমিকা রাখেন, ইতিহাসে তাঁরা উতরে যান। তাঁদের দায়িত্ব শেষ। জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মের। স্বাধীনতাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের দায়িত্ব কম নয়। তাদের ব্যর্থতা ও সফলতার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও সাফল্য।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা।

Tuesday, April 30, 2024

যাঁদের নিয়ে এই দিবস, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা অবগত?

 

পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিনটিকে আমরা মে দিবস বলেও জানি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবস বা পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। কিন্তু যাঁদের নিয়ে এই দিবস, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা অবগত? অনেক শ্রমিক জানেনই না এর ইতিহাস।

উনিশ শতাব্দীর আগে কারখানার শ্রমিকদের দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশি। কিন্তু কাজ অনুপাতে পারিশ্রমিক ছিল স্বল্প। যা তাঁদের জীবনধারণের জন্য যথাযথ ছিল না। একটা পর্যায়ে শ্রমিকপক্ষ ক্ষুব্ধ হতে থাকে। যা এক সময় আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানায়। এ দাবি পূরণের সময় হিসেবে ১৮৮৬ সালের ১ মে নির্ধারণ করেন শ্রমিকেরা। কিন্তু কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে তোলেননি। ফলাফলে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে ফের আন্দোলন গড়ে তোলেন শ্রমিকেরা। সেখানে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করলে নিহত হন ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক।

এ ঘটনার দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। পরে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানের সাড়া হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকেরা মে মাসের ১ তারিখ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানান। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি।

শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় মে দিবস। এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য থাকে শ্রমিকদের তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে করে তাঁরা মে দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন ও নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আমরা মে দিবস পালন করি, সেটি কতটা সফল হয়, তা নিতে প্রশ্ন আসতে পারে। আসাটা বেশ স্বাভাবিক।

মে দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবুও কিছু মানুষ রুটিরুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন কাজে। কারণ এক বেলা কাজ না করলে তাঁর পরিবারকে কাটাতে হবে অনাহারে। কারও কারও আবার মেলে না ছুটি। ছুটির দিনে কাজের জন্য জোটে না বাড়তি অর্থও। আট ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। কাজ করতে হচ্ছে আট ঘণ্টার অধিক। দেওয়া হচ্ছে না ওভারটাইম বা অতিরিক্ত সময়ের পয়সা। মে দিবস পালন তো এসব মানুষের কাছে একপ্রকার বিলাসিতাই।

আমরা দেখি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কর্মরত। প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানায় আট ঘণ্টার বেশি কাজ হয় প্রতিদিন। ওভারটাইম করতে আগ্রহী না থাকলেও বাধ্য হয়ে তা করতে হয়। সেই ওভারটাইমের টাকাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না বা দিতে নানা ছলচাতুরী করে মালিকপক্ষ। শুধু গার্মেন্ট শিল্প নয়, অধিকাংশ খাতে এমন পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাই।

ইপিজেড বা জোনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন থাকার পরও শ্রমিকরা এই আইনের সুরক্ষা পাচ্ছেনা। শ্রম আইনে প্রতি পাঁচ বছর পর পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করার কথা থাকলেও শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার না হলে তা হয়না। গত ডিসেম্বরে ন্যূনতম মজুরির আন্দলন করতে গিয়ে একজন নারী শ্রমিক সহ তিন জন শ্রমিক নিহত হয়। গ্রেফতার এবং আহত হয় কয়েকশত শ্রমিক।হাজার হাজার শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করা হয়।

বাংলাদেশে রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টসহ অনেক দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়েছেন। সেই সঙ্গে হারিয়েছেন বহু আশা ও স্বপ্ন। অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সামান্য ক্ষতিপূরণে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অনেক সময় সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলেও মালিক-শ্রমিক সমন্বয়হীনতায় বৃথা যায় সব।

এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা কতটা শোচনীয়। কিন্তু মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। শ্রমিকদের ভাগ্য আর পরিবর্তন হয় না। ফলে পালনের জন্য মে দিবস পালন না হোক। এর মুখ্য উদ্দেশ্যই হোক শ্রমিকের অধিকার আদায় ও শ্রমিকের নিরাপত্তা। আট ঘণ্টার অধিক কাজ নয়। এর বেশি কাজ করলে ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, সেটি সময়মতোই। বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের আরও বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিকদের সব দাবি মালিকপক্ষ বা সরকারের কাছে তারা তুলে ধরতে পারে। তাতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের দূরত্ব অনেকখানি লাঘব হবে। শ্রম আইনগুলো কঠোরতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে শ্রমিকবান্ধব আইন, যা শ্রমিকদের স্বার্থে কথা বলবে। এর মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি বৈষম্যহীন শ্রমিক বান্ধব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি।

লেখকঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ এর একটি রোডম্যাপ

  বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক কোন ভিত্তি নেই। তবুও যেহেতু একটা আন্দোলনের...