পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিনটিকে আমরা মে দিবস বলেও জানি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবস বা পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। কিন্তু যাঁদের নিয়ে এই দিবস, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা অবগত? অনেক শ্রমিক জানেনই না এর ইতিহাস।
উনিশ শতাব্দীর আগে কারখানার
শ্রমিকদের দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চাইতেও
বেশি। কিন্তু কাজ অনুপাতে পারিশ্রমিক ছিল স্বল্প। যা তাঁদের জীবনধারণের জন্য যথাযথ
ছিল না। একটা পর্যায়ে শ্রমিকপক্ষ ক্ষুব্ধ হতে থাকে। যা এক সময় আন্দোলনে রূপ নেয়।
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক আট ঘণ্টা
কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানায়। এ দাবি পূরণের সময় হিসেবে ১৮৮৬ সালের ১ মে
নির্ধারণ করেন শ্রমিকেরা। কিন্তু কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে
তোলেননি। ফলাফলে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে ফের আন্দোলন গড়ে
তোলেন শ্রমিকেরা। সেখানে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করলে নিহত হন
১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক।
এ
ঘটনার দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল
থেকে পালনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে
প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। পরে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে
অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময়
নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন
মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি
আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানের সাড়া হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে
বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকেরা মে মাসের ১ তারিখ
সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানান। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির
দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাশিয়া, চীন,
বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন
স্থানে এ দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দৈনিক আট
ঘণ্টা কাজ করার দাবি।
শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি
সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস
পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার
পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে
দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে যথাযথ মর্যাদায়
পালিত হয় মে দিবস। এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য থাকে শ্রমিকদের তাঁদের অধিকার
সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে করে তাঁরা মে দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন
ও নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আমরা মে দিবস পালন করি, সেটি
কতটা সফল হয়, তা নিতে প্রশ্ন আসতে পারে। আসাটা বেশ
স্বাভাবিক।
মে দিবসে সব সরকারি, আধা
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবুও কিছু মানুষ রুটিরুজির সন্ধানে বেরিয়ে
পড়েছেন কাজে। কারণ এক বেলা কাজ না করলে তাঁর পরিবারকে কাটাতে হবে অনাহারে। কারও
কারও আবার মেলে না ছুটি। ছুটির দিনে কাজের জন্য জোটে না বাড়তি অর্থও। আট ঘণ্টা
কাজের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। কাজ করতে হচ্ছে আট ঘণ্টার
অধিক। দেওয়া হচ্ছে না ওভারটাইম বা অতিরিক্ত সময়ের পয়সা। মে দিবস পালন তো এসব
মানুষের কাছে একপ্রকার বিলাসিতাই।
আমরা দেখি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক
শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কর্মরত। প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানায় আট ঘণ্টার বেশি
কাজ হয় প্রতিদিন। ওভারটাইম করতে আগ্রহী না থাকলেও বাধ্য হয়ে তা করতে হয়। সেই
ওভারটাইমের টাকাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না বা দিতে নানা ছলচাতুরী করে মালিকপক্ষ। শুধু
গার্মেন্ট শিল্প নয়, অধিকাংশ খাতে এমন পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাই।
ইপিজেড বা জোনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে
শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ,
কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ,
শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি
বিষয় নিয়ে দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন থাকার পরও শ্রমিকরা এই আইনের সুরক্ষা
পাচ্ছেনা। শ্রম আইনে প্রতি পাঁচ বছর পর পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি
ঘোষণা করার কথা থাকলেও শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার না হলে তা হয়না। গত ডিসেম্বরে ন্যূনতম
মজুরির আন্দলন করতে গিয়ে একজন নারী শ্রমিক সহ তিন জন শ্রমিক নিহত হয়। গ্রেফতার এবং
আহত হয় কয়েকশত শ্রমিক।হাজার হাজার শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করা হয়।
বাংলাদেশে রানা প্লাজা, তাজরীন
গার্মেন্টসহ অনেক দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়েছেন। সেই সঙ্গে হারিয়েছেন বহু আশা ও স্বপ্ন। অনেক
পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সামান্য ক্ষতিপূরণে তাদের
সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অনেক সময় সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলেও মালিক-শ্রমিক
সমন্বয়হীনতায় বৃথা যায় সব।
এতেই
বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা কতটা
শোচনীয়। কিন্তু মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। শ্রমিকদের
ভাগ্য আর পরিবর্তন হয় না। ফলে পালনের জন্য মে দিবস পালন না হোক। এর মুখ্য
উদ্দেশ্যই হোক শ্রমিকের অধিকার আদায় ও শ্রমিকের নিরাপত্তা। আট ঘণ্টার অধিক কাজ নয়।
এর বেশি কাজ করলে ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, সেটি সময়মতোই।
বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের আরও বেশি অগ্রণী
ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিকদের সব দাবি মালিকপক্ষ বা সরকারের কাছে তারা তুলে ধরতে
পারে। তাতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের দূরত্ব অনেকখানি লাঘব হবে। শ্রম আইনগুলো কঠোরতার
সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে শ্রমিকবান্ধব আইন, যা শ্রমিকদের স্বার্থে কথা বলবে। এর মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি বৈষম্যহীন
শ্রমিক বান্ধব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি।
লেখকঃ খাইরুল মামুন
মিন্টু,
আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও
সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
No comments:
Post a Comment