বিভিন্ন জাতিসত্তা, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের
মানুষ সে রাষ্ট্রের নাগরিক অথচ অনেক স্বাধীন দেশের সব শ্রেণির মানুষ সমান স্বাধীন
ও মুক্ত নয়। যেমন, ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম, কিন্তু তার
সব নাগরিক স্বাধীন ও মুক্ত ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে আমরা কি তাহলে কারারুদ্ধ
ছিলাম? না, তা-ও ছিলাম না। আমরা হাঁটা-চলাফেরা করেছি, হাটবাজার করেছি, কিন্তু
মুক্ত বলতে যা বোঝায় তা ছিলাম না।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে
বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম, কিন্তু বাংলাদেশের সব নাগরিক স্বাধীন ও মুক্ত হয়েছে
কি? মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্যতা পেয়েছে কি?
আমার মনে হয়েছে, হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ
সেই গণতান্ত্রিক অধিকার চায়, যা তার ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য। যার জন্য আমরা ১৯৭১
সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ অর্জন করেছি
কিন্তু দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম পাওয়ার পরেও গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে
প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য এখন পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলছে।
অনেকে মনে করছেন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র
জনাতার গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকার বিদায় নিয়েছে। তার মানে
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায় হয়েছে। কিন্তু
অতীত তা বলছে না। মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের
গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম
পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নিগ্রহ ও শোষণের ইতিহাস যার অন্য পিঠে ছিল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১
সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক
বৈষম্য ছিল। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য।
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও
ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্যতা আদায় ও বৈষম্য দুরকরার জন্য আমরা ১৯৭১ সালে
মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ অর্জন করেছি।
১৯৭১ সালের পরে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার
ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে ১৯৭৫ সালে ১৫
আগস্টের ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু
বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে সপরিবারে নিহত হন যা ১৯৭৫ সালের
১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে সেনাবাহিনীর কিছু
বিপথগামী সদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মানুষের
গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে
নিয়ন্ত্রণ নেয় অভ্যুত্থানকারীরা।
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও
ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থান এর
মাধ্যে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এই দিনে ভোরে দেশে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা
দখল করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি
বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন জেনারেল এরশাদ।
টানা ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন জেনারেল এরশাদ।
তাঁর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলাম, সিপিবিসহ সব দলকে
আন্দোলন করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণ–আন্দোলনের মুখে পতন হয় জেনারেল এরশাদের
শাসনের।
তারপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি, ১৯৯৬
সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং তারা
দেশের উন্নয়নের কথা বলে বিভিন্ন কায়দা কানুন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল
কিন্তু গণ–আন্দোলনের মুখে
শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ আগেই
ঘোষণা দিয়েছিল যে, কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে লাগাতার অবরোধ
কর্মসূচি পালন করা হবে। সেই বার ২৮ অক্টোবর সামনে রেখে ঢাকা শহরে ছিল টানটান
উত্তেজনা। আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং নেতা–কর্মীদের লগি–বৈঠা নিয়ে আসতে বলে। বিএনপি ওই দিন নয়া
পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ও জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে
সমাবেশের কর্মসূচি নেয়। দুই পক্ষের রণপ্রস্তুতিতে সংঘাতের আশঙ্কা করা হয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর পুলিশ পল্টন
ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায়
প্রায় ১৫ হাজারের মতো পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তারপরও সেদিন সংঘাত বন্ধ ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও
জামায়াত–শিবিরের নেতা–কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় বায়তুল মোকাররম
এলাকায়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ওই দিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া
রাষ্ট্রপতির কাছে ইস্তফাপত্র দেন।
ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ অস্থির রাজনৈতিক
পরিস্থিতির মাঝে ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে সংসদ নির্বাচনের
আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা সৃষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থার
পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি তত্ִকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষনা
করেন। একই সাথে সেনা সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় যার প্রধান
উপদেষ্টা হিসেবে ফখরুদ্দীন আহমেদকে নিয়োগ করা হয়। ফখরুদ্দিন আহমেদ ক্ষমতা
গ্রহনের মধ্য দিয়ে ইতোপূর্বে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হয়। তিনি ২ বছর কেয়ার টেকার ছিলেন, ফখরুদ্দিন আহমেদ
দায়িত্ব গ্রহনের পর তত্ִকালীন জাতীয় জীবনে
রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখার জন্য বেশ প্রশংসিত
হন।
সে সময় বিশ্বের সর্বাধিক দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ
হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে ফখরুদ্দীন আহমেদ দূর্নীতিবিরোধী নানান কার্যক্রম পরিচালনা
করেন। সে সময় দেশের প্রায় ১৬০ জন রাজ্নীতিক, সরকারী কর্মকর্তা, নিরাপত্তা
কর্মকর্তার নামে অর্থ আত্মসাত্ִ ও অন্যান্য
দূর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়।এসময় দেশের ভূতপূর্ব দুই প্রধানমন্ত্রী
খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী জাতীয়
সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে
সরকার গঠন করলে ফখরুদ্দিন আহমেদ গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হয়।
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও
ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের কথা বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও জনতার ২৩ দিনের
দেশ কাঁপানো আন্দোলনে শত শত মানুষের রক্তের বিনিময়ে ২০২৪ সালের ৫
আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা
দেন শেখ হাসিনা। এরপর বঙ্গভবন থেকেই হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের
মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হলো।
গত ৮ আগস্ট ২০২৪, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।
এই সরকার কত দিন থাকবে তা এখন পর্যন্ত ঠিক নেই। তবে এই কইদিনে আমার মনে হয়েছে শেখ
হাসিনার সরকারের পথেই হাটছে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে
দেশে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিরোধী মতের লোকদের গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন,
রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের হয়রানি ও গণগ্রেফতার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে ফ্যাসিবাদী
একনায়কত্ব তৈরি করে, নির্বাচনী বিজয়, সহিংসতা এবং জরুরি ক্ষমতার সমন্বয়ের
মাধ্যমে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করে। ইউরোপের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
ফ্যাসিবাদী মডেলের উপর ভিত্তি করে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। একটি গণতান্ত্রিক
সরকার মানে হলো জবাবদিহিমূলক সরকার। তারা সংবিধানিক প্রক্রিয়াকে অপব্যবহারের
মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিকৃতি ঘটাতে পারবে,
তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবে।
ইতিহাসের অমোঘ সত্য হলো প্রত্যেক একনায়কই
মনে করে যে তারা তাদের দেশে এক অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও শান্তি বয়ে আনতে পারবে, যদি
শুধু তারা দেশের মধ্যে নাগরিক সমাজের বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর ও বিরোধীদের সমালোচনাকে
থামিয়ে দেয়। শেখ হাসিনা প্রথম ও শেষ শাসক নন, যিনি এই মোহের ফাঁদে পড়েছিলেন।
প্রত্যেক (স্বৈর) শাসকই উন্মাদনায় মেতে ওঠে আর শেষ পরিণতিতে সেনাবাহিনী অথবা
উন্মত্ত জনতা শাসকের প্রাসাদ তছনছ করে দেয়।
উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে
জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করার কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী নোবেল বিজয়ী
অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
কিন্তু বাস্তবতা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আমি মনে করি কোনো দেশের রাস্তাঘাট, বড় বড়
স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের
প্রয়োজন হয় না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা,
মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে’ বর্তমান
মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দেন এবং
ভূমিকা রাখেন, ইতিহাসে তাঁরা উতরে যান। তাঁদের দায়িত্ব শেষ। জনগণের মুক্তির জন্য
কাজ করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মের। স্বাধীনতাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে
তাদের দায়িত্ব কম নয়। তাদের ব্যর্থতা ও সফলতার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা
ও সাফল্য।
লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, ট্রেড
ইউনিয়ন নেতা।
No comments:
Post a Comment