বাংলাদেশে কিছু ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী বা সংগঠনের নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য এবং তাদের অধিকারের পথে বাধা সৃষ্টির বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সকলের এবং সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আমাদের করণীয়:
- সোশ্যাল
মিডিয়ায় সচেতনতা বৃদ্ধি: এই গোষ্ঠীগুলোর
অপপ্রচার এবং বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি
করতে হবে। নারীদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং সমাজে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার
কথা তুলে ধরতে হবে। তাদের ভুল ব্যাখ্যার উপযুক্ত জবাব তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে
দিতে হবে।
- গণমাধ্যমে
আলোচনা ও প্রতিবাদ: মূলধারার গণমাধ্যম (টিভি,
সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল) এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। টকশো,
প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভুল ধারণা এবং সমাজের
উপর এর নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরতে হবে। নারী অধিকার কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং
সমাজের সচেতন অংশকে এই আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে।
- আইনি
পদক্ষেপের জন্য উৎসাহিত করা: যারা
সরাসরি অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করছে, হুমকি দিচ্ছে বা নারীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি
করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীদের উৎসাহিত করতে
হবে। এক্ষেত্রে আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলো
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
- নারী
অধিকার সংগঠনগুলোর শক্তিশালী ভূমিকা: নারী
অধিকার সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। তারা ভুক্তভোগীদের আইনি ও মানসিক
সহায়তা প্রদান করতে পারে, জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে এবং সরকারের কাছে
জোরালো দাবি জানাতে পারে।
- পারিবারিক
ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা: পরিবার
এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী-পুরুষের সমতা এবং নারীর অধিকারের বিষয়ে
আলোচনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কুসংস্কার এবং ভুল ধারণাগুলো দূর করতে
হবে।
- শিক্ষা
ব্যবস্থার সংস্কার: শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নারী অধিকার,
জেন্ডার সমতা এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর
মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে একটি আধুনিক ও সহনশীল মানসিকতা নিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব
হবে।
- ধর্মীয়
নেতাদের ভূমিকা: প্রগতিশীল ও উদারপন্থী ধর্মীয়
নেতাদের এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ইসলামের
সঠিক শিক্ষা এবং নারীর মর্যাদা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। তাদের
কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত:
- স্পষ্ট
ও দৃঢ় অবস্থান: সকল রাজনৈতিক দলের নারী
অধিকারের প্রশ্নে একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। কোনো ধরনের
মৌলবাদী গোষ্ঠীর নারী বিদ্বেষী মন্তব্যের প্রতি নমনীয়তা দেখানো উচিত নয়।
নারী অধিকারের সুরক্ষা এবং নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দলীয় নীতি
সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
- বিদ্বেষপূর্ণ
বক্তব্যের নিন্দা: রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে
প্রকাশ্যে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নারী বিদ্বেষী ও অশ্লীল বক্তব্যের
নিন্দা জানাতে হবে। এই ধরনের মন্তব্য সমাজের শান্তি ও নারীর অগ্রগতির জন্য
ক্ষতিকর - এই বার্তা জোরালোভাবে প্রচার করতে হবে।
- আইনি
পদক্ষেপের সমর্থন: যারা নারীর প্রতি বিদ্বেষ
ছড়াচ্ছে এবং তাদের চলাচলে বাধা দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে
সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানাতে হবে। প্রয়োজনে এই ধরনের অপরাধের জন্য কঠোর আইন
প্রণয়নের পক্ষে জনমত তৈরি করতে হবে এবং সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে।
- দলের
অভ্যন্তরে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি: প্রতিটি
রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের নিজেদের দলের অভ্যন্তরে সকল স্তরে নারী নেতৃত্ব
বৃদ্ধি করা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে
নারী অধিকারের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব পাবে।
- নির্বাচনী
ইশতেহারে নারী অধিকারের প্রতিশ্রুতি: আগামী
নির্বাচনগুলোতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে নারী
অধিকারের সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর
করার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
- জনসচেতনতা
বৃদ্ধি: রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মী ও
সমর্থকদের মধ্যে নারী অধিকার এবং জেন্ডার সমতার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য
নিয়মিত আলোচনা সভা, সেমিনার ও প্রচারণার আয়োজন করতে পারে।
- সরকারের
উপর চাপ সৃষ্টি: রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে এবং
সংসদের বাইরে নারী অধিকারের সুরক্ষা এবং মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা রোধে
সরকারের উপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
- অন্যান্য
দলের সাথে সহযোগিতা: নারী অধিকারের প্রশ্নে অন্যান্য
প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলোর সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ
করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। একটি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এই ধরনের অপশক্তির
বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে লড়াই করতে সাহায্য করবে।
- ধর্মীয়
নেতাদের সাথে আলোচনা: প্রগতিশীল ও উদারপন্থী ধর্মীয়
নেতাদের সাথে আলোচনা করে তাদের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়ে সঠিক
বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিক
দলগুলোর এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা নারীর অধিকার রক্ষা এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও
প্রগতিশীল সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সরকারের করণীয়:
- জিরো
টলারেন্স নীতি: নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ
মন্তব্য, হুমকি এবং অধিকারের পথে বাধা সৃষ্টিকারী যেকোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে
সরকারকে কঠোর 'জিরো টলারেন্স' নীতি অবলম্বন করতে হবে।
- আইনের
কঠোর প্রয়োগ: বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এই ধরনের
অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন আরও কঠোর করতে হবে।
- সোশ্যাল
মিডিয়া মনিটরিং: সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্বেষপূর্ণ
মন্তব্য ও অপপ্রচার কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
নিতে হবে।
- প্রশাসন
ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রশিক্ষণ: প্রশাসন
এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং নারী অধিকারের বিষয়ে
নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা এই ধরনের ঘটনাগুলো গুরুত্বের
সাথে বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।
- নারী
ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সক্রিয়তা: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোর কার্যক্রম
আরও জোরদার করতে হবে এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপ নিতে হবে।
- জাতীয়
নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন: জাতীয়
নারী উন্নয়ন নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং নারীর অধিকার ও
ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে।
- জনসচেতনতা
কার্যক্রম: সরকার বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের
মাধ্যমে নারী অধিকার এবং জেন্ডার সমতার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য
নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
- আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক নারী
অধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতা করে
নারীর অধিকার সুরক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
এই সম্মিলিত
পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নারী বিদ্বেষী
কার্যকলাপ এবং নারীর অধিকারের পথে বাধা দানকারী অপচেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব হবে
এবং একটি Progressive ও gender-equal সমাজ গঠন করা যাবে।
লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
No comments:
Post a Comment