Followers

Thursday, May 29, 2025

জীবনের চার দেয়াল

 

মানুষের জীবন যেন এক চর্তুভুজ, যার চারটি বাহু দক্ষতা, কর্মজীবন, সংসার এবং আবেগ ও প্রেম ভালোবাসা। এই চারটি বিষয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আমাদের অস্তিত্বকে পূর্ণতা দেয়। কিন্তু এই চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে অনেক সময় আমরা নিজেদের সত্তাকে হারিয়ে ফেলি, ‘আমার জীবন’ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

প্রথমত, দক্ষতার কথা ধরা যাক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে টিকে থাকতে হলে বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। শৈশবে হাঁটা, বলা শেখা থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জন এবং কর্মজীবনে বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন এই প্রক্রিয়া অবিরাম চলতে থাকে। প্রতিযোগিতার এই যুগে টিকে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করতে হয়, নতুন কিছু শিখতে হয়। এই দক্ষতা অর্জনের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় আমরা নিজেদের পছন্দের জগৎ থেকে দূরে সরে যাই।

এরপর আসে কর্মজীবন। জীবিকা নির্বাহের জন্য, সমাজে নিজের স্থান তৈরি করার জন্য কর্ম অপরিহার্য। দিনের সিংহভাগ সময় কর্মক্ষেত্রে ব্যয় হয়। অফিসের সময়সীমা, বসের চাপ, সহকর্মীদের সাথে প্রতিযোগিতা এই সব মিলিয়ে কর্মজীবন অনেক সময় ক্লান্তিকর এবং যান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত শখ, আগ্রহ বা বিশ্রাম নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। কর্মজীবনের এই ঘূর্ণাবর্তে আমরা এতটাই আবর্তিত হই যে নিজের জন্য একটুও সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সংসার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পরিবার, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান এদের নিয়েই আমাদের জগৎ তৈরি হয়। তাদের প্রয়োজন মেটানো, তাদের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের লালন-পালন, পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতা বা অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে অনেক সময় জলাঞ্জলি দিই। সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ‘আমি’ নামক সত্তাটি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে।

সবশেষে আবেগ ও প্রেম ভালোবাসার কথা বলা যাক। মানুষের জীবনে ভালোবাসা এক অপরিহার্য অনুভূতি। পরিবার, বন্ধু বা জীবনসঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা আমাদের বাঁচতে শেখায়, অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু এই আবেগ অনেক সময় আমাদের দুর্বল করে তোলে, অন্যের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ বা প্রিয়জনের হারানোর বেদনা আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে নিজের জীবন বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। অন্যের আবেগ ও অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হতে গিয়ে আমরা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাই।

এই চারটি বিষয় দক্ষতা অর্জন, কর্মজীবনের চাপ, সংসারের দায়িত্ব এবং আবেগের জটিলতা আমাদের জীবনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যে অনেক সময় মনে হয় আমরা যেন এক অদৃশ্য কারাগারে বন্দি। নিজের জন্য সময় বের করা, নিজের শখ পূরণ করা বা নিজের মতো করে কিছু ভাবার অবকাশ প্রায় থাকে না। জীবনের এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের ‘আমি’ কে কোথাও হারিয়ে ফেলি।

তবে কি এর কোনো সমাধান নেই? হয়তো আছে। প্রয়োজন সচেতনতার, নিজের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার। দক্ষতা অর্জন, কর্মজীবন, সংসার এবং আবেগ এই সবকিছুই জীবনের অংশ, কিন্তু এটাই জীবনের শেষ কথা নয়। এই চার দেয়ালের বাইরেও একটি জগৎ আছে, যেখানে শুধু ‘আমি’ বিরাজ করি। সেই ‘আমি’ কে খুঁজে বের করতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে, তার পরিচর্যা করতে হবে।

নিয়মিত বিশ্রাম, নিজের পছন্দের কাজ করা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া অথবা শুধু কিছুক্ষণ নীরব থাকা এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমাদের নিজেদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। মনে রাখতে হবে, অন্যের জন্য বাঁচতে গিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ একটি সুস্থ, সুখী এবং আত্মতৃপ্ত ‘আমি’ ই পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্রে আরও ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।

তাই আসুন, জীবনের এই চার দেয়ালের মাঝেও নিজেদের জন্য একটু জায়গা করে নিই। নিজের স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখি, নিজের শখগুলোকে লালন করি। কারণ শেষ পর্যন্ত, নিজের জীবনই আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।

KM Mintu

No comments:

Post a Comment

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প: সমৃদ্ধির আড়ালে শ্রমিকদের দুর্দশা:

  বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো পোশাক শিল্প। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। বিশ্বজুড়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ...