বাংলাদেশের অর্থনীতির
প্রধান চালিকাশক্তিগুলোর অন্যতম হলো তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্প। রপ্তানি আয়ের প্রায়
৮০ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে এই খাত থেকে। এই
খাতের পেছনে যাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাঁরা হলেন আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকেরা—যাঁদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ, যার অধিকাংশই
নারী। এই শ্রমিকরা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই অবদান রাখছেন না, বরং নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য
বিমোচন এবং সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
বাজেট
নিয়ে শ্রমিকদের প্রত্যাশা
প্রতি বছর যখন
জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়, তখন শুধু কর্পোরেট খাত নয়, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ
করে শ্রমজীবী মানুষও বাজেটের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁদের আশা থাকে—বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের ন্যায্য
অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়টি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এই প্রত্যাশা
ভিন্ন নয়। প্রতি বছরের মতো এবারও শ্রমিকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের
বাজেটে তাদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলো প্রতিফলিত হবে।
তাদের মূল দাবিগুলোর
মধ্যে ছিল—
- ন্যূনতম মজুরি পুনঃনির্ধারণ ও বৃদ্ধির
সুনির্দিষ্ট ঘোষণা
- দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে
মজুরি সমন্বয়ের পরিকল্পনা
- কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ও মাতৃত্বকালীন
সুবিধা
- দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ
ও সামাজিক নিরাপত্তা
- শ্রমিকদের জন্য আবাসন, রেশন ও শিশুশিক্ষার
সুবিধা
- নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ
নিশ্চিত করা
বাজেট
ঘোষণার পর হতাশা
কিন্তু ২০২৬-২৭
অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে স্পষ্ট হতাশা বিরাজ করছে। বাজেট
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শ্রমিকদের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট কোন প্রস্তাবনা বা প্রকল্পের উল্লেখ
নেই বললেই চলে। অথচ গার্মেন্টস খাত থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত
হয়, তা জাতীয় অর্থনীতিতে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে। এতো বড় অবদান সত্ত্বেও এই খাতের
কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে বাজেটে দৃশ্যমান কোনো অগ্রাধিকার দেখা যায়নি।
মজুরি বৃদ্ধির
কোনো ঘোষণা নেই, বরং আগের ন্যূনতম মজুরি (১২৫০০ টাকা, যা ২০২৩ সালে নির্ধারিত হয়েছিল)
এখনও কার্যকর রয়েছে—যা বর্তমান বাজার
পরিস্থিতিতে কার্যত অপ্রতুল। শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, গৃহভাড়া, পরিবহন, চিকিৎসা ও শিক্ষা—সব খাতে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণে। এক্ষেত্রে
মজুরি বাড়ানোর পদক্ষেপ না নেওয়া শ্রমিকদের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।
অব্যবস্থাপনা
ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব
গার্মেন্টস শ্রমিকরা
প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করেন। বহু কারখানায় এখনও শ্রম আইন পূর্ণভাবে
বাস্তবায়ন হয় না। শ্রমিকদের চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ডের
কার্যকর ব্যবহার—এইসব মৌলিক অধিকারও
নিশ্চিত নয়। অথচ বাজেটে এই ঘাটতিগুলো পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ বা কাঠামোগত
পরিকল্পনার অভাব লক্ষ্য করা গেছে।
এছাড়া শ্রমিকদের
জন্য জাতীয় পর্যায়ের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর দাবিও এবার বাজেটে উপেক্ষিত
হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের কার্যকর ব্যবহার এবং নিয়মিত মনিটরিং না থাকার
ফলে এই খাতটি দিন দিন গুরুত্ব হারাচ্ছে।
সম্ভাব্য
প্রভাব ও করণীয়
এই উপেক্ষার ফলে
শ্রমিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে। তাদের মধ্যে এক ধরনের
হতাশা তৈরি হয়েছে, যা মনোবলে আঘাত করছে এবং দীর্ঘমেয়াদে শিল্প খাতের উৎপাদনশীলতা ও
স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। কোনো খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য কেবল অবকাঠামোগত
বিনিয়োগই যথেষ্ট নয়; মানবসম্পদের উন্নয়ন, বিশেষ করে শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করাও
সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার যদি এই শ্রমিকদের
আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবহেলা করে, তবে তা অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে শিল্পে শ্রম অস্থিরতা, ধর্মঘট এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাহানির
মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশ যদি সত্যিই
একটি শ্রম-নির্ভর রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে চায়, তবে শ্রমিকদের
ন্যায্য অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা জরুরি। বাজেট শুধু ধনী ও কর্পোরেট খাতের জন্য
নয়, শ্রমজীবী জনগণের প্রতিও দায়বদ্ধ।
২০২৬-২৭ অর্থবছরের
বাজেট গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য একটি বড় পরিমাণে মিসড অপারচুনিটি। আমরা আশা করি, সরকার
ও নীতিনির্ধারকরা এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সংশোধিত বাজেট বা মধ্যমেয়াদি
পরিকল্পনায় শ্রমিক কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করবেন। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, কর্মজীবী
মানুষের জীবনমানের উন্নয়নও একটি উন্নত বাংলাদেশের পূর্বশর্ত।
No comments:
Post a Comment