Followers

Thursday, May 29, 2025

জীবনের চার দেয়াল

 

মানুষের জীবন যেন এক চর্তুভুজ, যার চারটি বাহু দক্ষতা, কর্মজীবন, সংসার এবং আবেগ ও প্রেম ভালোবাসা। এই চারটি বিষয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আমাদের অস্তিত্বকে পূর্ণতা দেয়। কিন্তু এই চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে অনেক সময় আমরা নিজেদের সত্তাকে হারিয়ে ফেলি, ‘আমার জীবন’ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

প্রথমত, দক্ষতার কথা ধরা যাক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে টিকে থাকতে হলে বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। শৈশবে হাঁটা, বলা শেখা থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জন এবং কর্মজীবনে বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন এই প্রক্রিয়া অবিরাম চলতে থাকে। প্রতিযোগিতার এই যুগে টিকে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করতে হয়, নতুন কিছু শিখতে হয়। এই দক্ষতা অর্জনের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় আমরা নিজেদের পছন্দের জগৎ থেকে দূরে সরে যাই।

এরপর আসে কর্মজীবন। জীবিকা নির্বাহের জন্য, সমাজে নিজের স্থান তৈরি করার জন্য কর্ম অপরিহার্য। দিনের সিংহভাগ সময় কর্মক্ষেত্রে ব্যয় হয়। অফিসের সময়সীমা, বসের চাপ, সহকর্মীদের সাথে প্রতিযোগিতা এই সব মিলিয়ে কর্মজীবন অনেক সময় ক্লান্তিকর এবং যান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত শখ, আগ্রহ বা বিশ্রাম নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। কর্মজীবনের এই ঘূর্ণাবর্তে আমরা এতটাই আবর্তিত হই যে নিজের জন্য একটুও সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সংসার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পরিবার, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান এদের নিয়েই আমাদের জগৎ তৈরি হয়। তাদের প্রয়োজন মেটানো, তাদের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের লালন-পালন, পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতা বা অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে অনেক সময় জলাঞ্জলি দিই। সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ‘আমি’ নামক সত্তাটি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে।

সবশেষে আবেগ ও প্রেম ভালোবাসার কথা বলা যাক। মানুষের জীবনে ভালোবাসা এক অপরিহার্য অনুভূতি। পরিবার, বন্ধু বা জীবনসঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা আমাদের বাঁচতে শেখায়, অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু এই আবেগ অনেক সময় আমাদের দুর্বল করে তোলে, অন্যের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ বা প্রিয়জনের হারানোর বেদনা আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে নিজের জীবন বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। অন্যের আবেগ ও অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হতে গিয়ে আমরা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাই।

এই চারটি বিষয় দক্ষতা অর্জন, কর্মজীবনের চাপ, সংসারের দায়িত্ব এবং আবেগের জটিলতা আমাদের জীবনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যে অনেক সময় মনে হয় আমরা যেন এক অদৃশ্য কারাগারে বন্দি। নিজের জন্য সময় বের করা, নিজের শখ পূরণ করা বা নিজের মতো করে কিছু ভাবার অবকাশ প্রায় থাকে না। জীবনের এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের ‘আমি’ কে কোথাও হারিয়ে ফেলি।

তবে কি এর কোনো সমাধান নেই? হয়তো আছে। প্রয়োজন সচেতনতার, নিজের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার। দক্ষতা অর্জন, কর্মজীবন, সংসার এবং আবেগ এই সবকিছুই জীবনের অংশ, কিন্তু এটাই জীবনের শেষ কথা নয়। এই চার দেয়ালের বাইরেও একটি জগৎ আছে, যেখানে শুধু ‘আমি’ বিরাজ করি। সেই ‘আমি’ কে খুঁজে বের করতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে, তার পরিচর্যা করতে হবে।

নিয়মিত বিশ্রাম, নিজের পছন্দের কাজ করা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া অথবা শুধু কিছুক্ষণ নীরব থাকা এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমাদের নিজেদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। মনে রাখতে হবে, অন্যের জন্য বাঁচতে গিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ একটি সুস্থ, সুখী এবং আত্মতৃপ্ত ‘আমি’ ই পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্রে আরও ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।

তাই আসুন, জীবনের এই চার দেয়ালের মাঝেও নিজেদের জন্য একটু জায়গা করে নিই। নিজের স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখি, নিজের শখগুলোকে লালন করি। কারণ শেষ পর্যন্ত, নিজের জীবনই আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।

KM Mintu

Wednesday, May 28, 2025

বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সময় এখন

 

বাংলাদেশে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সময় এখন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তাদের আরও দৃঢ় এবং সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে একসময় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর বেশ শক্তিশালী অবস্থান ছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তবে কালের পরিক্রমায় এবং নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই ঐতিহ্য কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। বর্তমানে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যার কারণে তাদের কার্যক্রম এবং প্রভাব কিছুটা সীমিত হয়ে পড়েছে।

তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর এবং একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বিশেষত, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থান একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর সক্রিয় হওয়া এবং নিজেদের সংগঠিত করা আরও বেশি জরুরি।

স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে নস্যাৎ করতে চায়, তারা বিভিন্নভাবে সমাজে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ইতিহাস বিকৃতি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং মৌলবাদী চিন্তাধারা প্রসারের মাধ্যমে তারা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে পারে।

প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নানা ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো ঐতিহাসিকভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিল। এই পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অপতৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি সুস্থ ছাত্র রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো একটি বিকল্প এবং প্রগতিশীল ধারা তৈরি করতে পারে। একই সাথে, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির বিষাক্ত অনুপ্রবেশ রুখে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি সুস্থ ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

তৃতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো একটি নীতিগত অবস্থান নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির যেকোনো ধরনের আস্ফালন এবং তাদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং তাৎপর্য ছাত্র সমাজের মধ্যে তুলে ধরতে হবে।

তবে এই মুহূর্তে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোকে কিছু অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। নিজেদের মধ্যেকার বিভেদ ভুলে গিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। একই সাথে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাদের প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে হবে। গতানুগতিক স্লোগান এবং কর্মসূচির বাইরে গিয়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন আঙ্গিকে ছাত্র আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় একটি সুচিন্তিত এবং কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।

তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, ছাত্ররাই সমাজের ভবিষ্যৎ। একটি প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্র সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজের বৃহত্তর পরিসরে ছাত্র আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং সাধারণ মানুষের সাথে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর এটাই উপযুক্ত সময়। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার জন্য তাদের আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, আদর্শ এবং ত্যাগদীপ্ত ইতিহাসকে সাথে নিয়ে নতুন উদ্যমে পথ চলতে হবে। ছাত্র ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে একটি শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন সময়ের দাবি, যা একইসাথে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির উত্থানকে রুখে দিতে সক্ষম হবে।

Monday, May 19, 2025

প্রেম: আলো-আঁধারের এক অনন্ত খেলা

 

প্রেম, সত্যিই এক রহস্যময় অনুভূতি। কখনো তা স্নিগ্ধ আলোয় মনকে ভরিয়ে তোলে, আবার কখনো গভীর আঁধারে ডুবিয়ে দেয় আত্মাকে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ঠিক তেমনইআমার মনের গভীরে এক আলো-আঁধারের খেলা চলছে অবিরাম। তোমার উষ্ণ স্পর্শ যেন ভোরের আলো, যা আমার সকল বিষণ্ণতা দূর করে এক নতুন দিনের সূচনা করে। আবার তোমার নীরবতা, তোমার উদাসীনতা যেন গভীর রাতের আঁধার, যা আমার হৃদয়কে শীতল করে তোলে, ডুবিয়ে দেয় এক সীমাহীন শূন্যতায়।

আমার ভালোবাসা তোমার জন্য এক গভীর সমুদ্রের মতো, যার তলদেশে লুকানো আছে অগুনতি আবেগ, অনন্ত অপেক্ষা। প্রতিটি নিঃশ্বাসে তোমার নাম, প্রতিটি স্বপ্নে তোমার ছবি। আমার হৃদয় জুড়ে শুধু তুমি, তোমার হাসি, তোমার কথা, তোমার স্পর্শ। এই ভালোবাসা আমার অস্তিত্বের প্রতিটি কণায় মিশে গেছে, এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে আমার জীবনের।

কিন্তু আমার মনের গভীরে একটি চাপা ভয় লুকিয়ে থাকে। তোমার মনের আঙিনায় কি আমার জন্য এতটুকু স্থান আছে? তোমার হৃদয়ের গভীরে কি আমার ভালোবাসার প্রতিধ্বনি শোনা যায়? হয়তো আমার এই গভীর আবেগ তোমার কাছে কেবলই এক তুচ্ছ অনুভূতি, হয়তো আমার ব্যাকুলতা তোমার মনে কোনো আলোড়নই তোলে না। এই ভাবনা আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে, প্রতিটি মুহূর্তে এক তীব্র যন্ত্রণার জন্ম দেয়।

অভিমান জমা হয় বুকের গভীরে, এক নীরব কষ্টের বাঁধ গড়ে তোলে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলতে, আমার এই ব্যাকুলতা তুমি কেন বোঝো না? কেন তোমার উদাসীন দৃষ্টি আমার হৃদয়ের গভীরে তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিদ্ধ হয়? কিন্তু সেই অভিমান ঠোঁটের কোণে এসেও থেমে যায়, পাছে আমার কোনো কথায় তোমার মনে কষ্ট হয়।

তাইতো, আমি নীরবে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকিএক অভিমানী প্রেমিক, যার চোখে জমে আছে না বলা কথা, অব্যক্ত বেদনা। আমার দৃষ্টিতে মেশে আকুল মিনতি, এক গভীর জিজ্ঞাসাতুমি কি সত্যিই বোঝো না আমার এই অন্তহীন ভালোবাসা?

অন্যদিকে, তুমিও হয়তো তাকিয়ে থাকো আমার দিকেএক অভিমানী প্রেমিকা, যার চোখে জমে আছে অভিযোগের মেঘ। হয়তো তোমার মনেও কোনো চাপা কষ্ট বাসা বেঁধেছে, কোনো না বলা কথা তোমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হয়তো আমার কোনো আচরণে তোমার মনে আঘাত লেগেছে, কোনো ভুল বোঝাবুঝি আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করেছে।

আমাদের দুজনের নীরব দৃষ্টি যেন এক অব্যক্ত সংলাপ। চোখের ভাষায় আমরা একে অপরের কাছে জানতে চাইছিকেন এই নীরবতা? কেন এই দূরত্ব? কেন আমাদের ভালোবাসার আকাশে আজ মেঘের ঘনঘটা?

প্রেম সত্যিই এক কঠিন পরীক্ষা। কখনো কাছে টানে, আবার কখনো দূরে ঠেলে দেয়। এই আলো-আঁধারের খেলায় কখনো আমরা আশার আলো দেখতে পাই, আবার কখনো নিরাশায় ডুবে যাই। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা সেই বাঁধাধরা মানে না। সকল অভিমান, সকল দূরত্ব অতিক্রম করে একদিন সেই ভালোবাসা আবার আলোর পথে যাত্রী হবেএই বিশ্বাস আমার হৃদয়ে আজও অমলিন।

Monday, May 12, 2025

তোমার খুশির সুর

 


প্রিয়, তিনটি দীর্ঘ দিনের পর আজ অবশেষে তোমার দেখা পেলাম। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল যদিও, কিন্তু তোমার হাসিমুখ দেখে সেই দেরিটুকুও সার্থক মনে হলো। কী কারণে ঠিক জানি না, তবে তোমার চোখমুখ জুড়ে ছিল এক নির্মল আনন্দের আভা। মনটা যেন কোনো এক অজানা খুশির স্রোতে ভাসছিল।

আর সেই আনন্দের প্রকাশ ঘটছিল তোমার অজান্তেই, মৃদু গুনগুন গানের সুরে। তোমার সেই আপন মনে গেয়ে ওঠা সুর আমার কানে এসে যখন লাগলো, মনে হলো যেন বহুদিন পর কোনো মিষ্টি ঝর্ণার শব্দ শুনছি। তোমার ওই গুনগুন সুর আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের চেয়েও মধুর।

সত্যি বলতে, তোমার ওই খুশি দেখে আমার মনটাও ভরে উঠেছে। তোমার ভালো থাকা, তোমার আনন্দে থাকা এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার কাছে আর কিছু নেই। তুমি যখন হাসো, পৃথিবীটা যেন আমার কাছে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। তোমার ওই সামান্য গুনগুন সুর আমার সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

তোমার এই খুশিটুকু অমলিন থাকুক, তোমার এই সুর কখনো থেমে না যাক। তুমি ভালো থেকো, আনন্দে থেকো সবসময়। কারণ তোমার ভালো থাকাতেই আমার সব আনন্দ।

Wednesday, May 7, 2025

সম্মিলিত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নারী বিদ্বেষী কার্যকলাপ এবং নারীর অধিকারের পথে বাধা দানকারী অপচেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব হবে

 


বাংলাদেশে কিছু ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী বা সংগঠনের নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য এবং তাদের অধিকারের পথে বাধা সৃষ্টির বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সকলের এবং সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

আমাদের করণীয়:

  • সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতা বৃদ্ধি: এই গোষ্ঠীগুলোর অপপ্রচার এবং বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নারীদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং সমাজে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরতে হবে। তাদের ভুল ব্যাখ্যার উপযুক্ত জবাব তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে দিতে হবে।
  • গণমাধ্যমে আলোচনা ও প্রতিবাদ: মূলধারার গণমাধ্যম (টিভি, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল) এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। টকশো, প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভুল ধারণা এবং সমাজের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরতে হবে। নারী অধিকার কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের সচেতন অংশকে এই আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে।
  • আইনি পদক্ষেপের জন্য উৎসাহিত করা: যারা সরাসরি অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করছে, হুমকি দিচ্ছে বা নারীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীদের উৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
  • নারী অধিকার সংগঠনগুলোর শক্তিশালী ভূমিকা: নারী অধিকার সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। তারা ভুক্তভোগীদের আইনি ও মানসিক সহায়তা প্রদান করতে পারে, জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে এবং সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাতে পারে।
  • পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা: পরিবার এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী-পুরুষের সমতা এবং নারীর অধিকারের বিষয়ে আলোচনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কুসংস্কার এবং ভুল ধারণাগুলো দূর করতে হবে।
  • শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার: শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নারী অধিকার, জেন্ডার সমতা এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে একটি আধুনিক ও সহনশীল মানসিকতা নিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
  • ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা: প্রগতিশীল ও উদারপন্থী ধর্মীয় নেতাদের এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ইসলামের সঠিক শিক্ষা এবং নারীর মর্যাদা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। তাদের কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত:

  • স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান: সকল রাজনৈতিক দলের নারী অধিকারের প্রশ্নে একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। কোনো ধরনের মৌলবাদী গোষ্ঠীর নারী বিদ্বেষী মন্তব্যের প্রতি নমনীয়তা দেখানো উচিত নয়। নারী অধিকারের সুরক্ষা এবং নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দলীয় নীতি সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
  • বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের নিন্দা: রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে প্রকাশ্যে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নারী বিদ্বেষী ও অশ্লীল বক্তব্যের নিন্দা জানাতে হবে। এই ধরনের মন্তব্য সমাজের শান্তি ও নারীর অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর - এই বার্তা জোরালোভাবে প্রচার করতে হবে।
  • আইনি পদক্ষেপের সমর্থন: যারা নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এবং তাদের চলাচলে বাধা দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানাতে হবে। প্রয়োজনে এই ধরনের অপরাধের জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের পক্ষে জনমত তৈরি করতে হবে এবং সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে।
  • দলের অভ্যন্তরে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি: প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের নিজেদের দলের অভ্যন্তরে সকল স্তরে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি করা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে নারী অধিকারের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব পাবে।
  • নির্বাচনী ইশতেহারে নারী অধিকারের প্রতিশ্রুতি: আগামী নির্বাচনগুলোতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে নারী অধিকারের সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি: রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নারী অধিকার এবং জেন্ডার সমতার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত আলোচনা সভা, সেমিনার ও প্রচারণার আয়োজন করতে পারে।
  • সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি: রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে এবং সংসদের বাইরে নারী অধিকারের সুরক্ষা এবং মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা রোধে সরকারের উপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
  • অন্যান্য দলের সাথে সহযোগিতা: নারী অধিকারের প্রশ্নে অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলোর সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। একটি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এই ধরনের অপশক্তির বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে লড়াই করতে সাহায্য করবে।
  • ধর্মীয় নেতাদের সাথে আলোচনা: প্রগতিশীল ও উদারপন্থী ধর্মীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করে তাদের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়ে সঠিক বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা নারীর অধিকার রক্ষা এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সরকারের করণীয়:

  • জিরো টলারেন্স নীতি: নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য, হুমকি এবং অধিকারের পথে বাধা সৃষ্টিকারী যেকোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর 'জিরো টলারেন্স' নীতি অবলম্বন করতে হবে।
  • আইনের কঠোর প্রয়োগ: বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এই ধরনের অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন আরও কঠোর করতে হবে।
  • সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং: সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য ও অপপ্রচার কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
  • প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রশিক্ষণ: প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং নারী অধিকারের বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা এই ধরনের ঘটনাগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।
  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সক্রিয়তা: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোর কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
  • জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন: জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে।
  • জনসচেতনতা কার্যক্রম: সরকার বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের মাধ্যমে নারী অধিকার এবং জেন্ডার সমতার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
  • আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক নারী অধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতা করে নারীর অধিকার সুরক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

এই সম্মিলিত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নারী বিদ্বেষী কার্যকলাপ এবং নারীর অধিকারের পথে বাধা দানকারী অপচেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব হবে এবং একটি Progressive ও gender-equal সমাজ গঠন করা যাবে।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

Tuesday, May 6, 2025

তিথির জীবন এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

 


ঢাকা থেকে অনেক দুরের শান্ত গ্রাম থেকে স্বপ্ন চোখে ঢাকায় এসেছিল তিথি। তার ছোট্ট সংসারে মা-বাবা আর তিন ভাইবোন। বাবার শরীরটা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল, তাই সংসারের হাল ধরতে তিথি একটি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। শহরের ব্যস্ত জীবন আর গার্মেন্টসের দমবন্ধ করা পরিবেশে তিথির মন খারাপ থাকত, তবুও পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সব কষ্ট সহ্য করত।

তিথি ছিল শ্যামলা বর্ণের মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে। তার সরলতা আর অমায়িক ব্যবহার খুব সহজেই মানুষের মন জয় করে নিত। কিন্তু এই গুণগুলোই কর্মক্ষেত্রে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। গার্মেন্টসের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশেষ করে তার সরাসরি বস, প্রায়ই তাকে অকারণে ডেকে পাঠাতেন, ব্যক্তিগত কাজের ফরমায়েশ করতেন। কখনও সরাসরি খারাপ কিছু না বললেও তাদের চোখের দৃষ্টি এবং ইঙ্গিতে তিথি অস্বস্তি বোধ করত। তাদের হাসি এবং কথা বলার ধরনে একটা কুৎসিত ইঙ্গিত থাকত, যা তিথির মনে ভয় আর বিতৃষ্ণা জাগাত।

একদিন রাতে কাজ শেষে যখন তিথি ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরছিল, তখন তার বস তাকে ডেকে একটি জরুরি ফাইলের কথা বলে ফ্যাক্টরির ভেতরে যেতে বলেন। ভেতরে গিয়ে তিথি বুঝতে পারে সেটি একটি অজুহাত ছিল। বস দরজা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে আসেন এবং অশালীন প্রস্তাব দেন। তিথি স্তম্ভিত হয়ে যায়, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালায় সে।

এই ঘটনার পর তিথি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তার মনে হতে থাকে যেন তার সম্মান আর আত্মমর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সে কাজে যেতে ভয় পায়, রাতে ঘুমাতে পারে না। তবুও, পরিবারের কথা ভেবে তাকে আবার কাজে যেতে হয়।

কিন্তু এবার তিথি একা ছিল না। কারখানার কয়েকজন সহকর্মী, যারা এর আগেও এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে বা শুনেছে, তারা তিথির পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর মুখ বুজে সহ্য করবে না। তারা গার্মেন্টসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে, যেখানে তিথির সাথে ঘটা ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয় এবং অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে হওয়া হয়রানির কথাও উল্লেখ করা হয়।

প্রথমে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ এবং স্থানীয় কিছু শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপে তারা বাধ্য হয় তদন্ত শুরু করতে। তদন্তে তিথির অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয় এবং সেই লম্পট কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

এই ঘটনা তিথির জীবনে একটি নতুন মোড় আনে। সে বুঝতে পারে যে একা না থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। তার মনে সাহস জন্মায় এবং সে ভাবে, শুধু নিজের নয়, আরও অনেক মেয়ের জন্য তাকে কিছু করতে হবে।

এরপর তিথি স্থানীয় একটি শ্রমিক শ্রমিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। সেখানে সে অন্যান্য নারী শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে শুরু করে। সে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেয় এবং নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে ভাগ করে নেয়, যাতে তারা সাহস পায় এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে।

ধীরে ধীরে তিথি একজন সাহসী ও স্পষ্টবাদী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। সে গার্মেন্টসে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন, কাজের পরিবেশ এবং নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে।

তিথি বুঝতে পারে, শুধু গার্মেন্টসে নয়, তার গ্রামের অন্যান্য মেয়েদেরও শিক্ষার অভাব এবং দারিদ্র্যের কারণে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, ভবিষ্যতে সে তার গ্রামে একটি ছোট স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে গরিব মেয়েরা বিনামূল্যে পড়াশোনা করতে পারবে এবং আত্মনির্ভরশীল হতে শিখবে।

তিথি এখন আর সেই ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটি নেই। কর্মক্ষেত্রে হওয়া ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাকে দুর্বল না করে বরং আরও শক্তিশালী করেছে। সে এখন অনেক নারীর অনুপ্রেরণা, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে সাহস যোগায়। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুধু তার নিজের জন্য নয়, বরং তার সমাজের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার আলো দেখায়। তিথি জানে, পথটা কঠিন, কিন্তু তার মনে যে সাহস আর সংকল্পের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, তা একদিন নিশ্চয়ই একটি সুন্দর ভবিষ্যতের বৃক্ষে পরিণত হবে।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু
আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র



Sunday, May 4, 2025

দূরত্ব আর নৈকট্যের দোল



যখন তুমি দূরে থাকো, তখন আমার মনের আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। একটা চাপা অভিমান বুকের ভেতর কিলবিল করে। মনে হয়, এত দূরে থেকেও কি একবারও আমার কথা মনে পড়ে না? একটা ছোট্ট বার্তারও কি সময় হয় না তোমার? সেই নীরব মুহূর্তগুলো আমার কাছে যেন দীর্ঘশ্বাস হয়ে আসে, কষ্টের এক একটা পাথর বুকের উপর চেপে বসে। মনে হয় যেন আমি একলা দ্বীপে বন্দি, যেখানে শুধু তোমার অনুপস্থিতির হাহাকার শোনা যায়।

তোমার সান্নিধ্যের অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। মনে হয় যেন আমার জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ কোথাও হারিয়ে গেছে। দিনের আলো ম্লান লাগে, রাতের আঁধার আরও গভীর হয়। প্রতিটি অপেক্ষার প্রহর যেন অনন্তকাল ধরে চলে। কেন তুমি বোঝো না, তোমার একটি ছোট্ট কুশল বার্তাও আমার কাছে কতটা মূল্যবান? কেন বোঝো না, তোমার একটুখানি মনোযোগ আমার মলিন হৃদয়কে কতটা শান্তি দিতে পারে? এই দূরত্ব আমার মনে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যা সহজে শুকায় না।

অথচ, যখন তুমি কাছে আসো, তখন সব মেঘ সরে যায়, আকাশ আবার ঝলমল করে ওঠে। তোমার আন্তরিকতা আমার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। তোমার চোখের সেই স্নিগ্ধ চাউনি, তোমার হাতের স্পর্শ, তোমার মুখের মিষ্টি কথা সবকিছু যেন এক জাদুকরী পরশ বুলিয়ে আমার ভেতরের সব কষ্ট দূর করে দেয়। মনে হয় যেন দীর্ঘ বিরতির পর প্রাণ ফিরে পেয়েছি। তোমার পাশে থাকলে আমি পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে যাই। তোমার উপস্থিতি আমার জীবনে এক নতুন আলো নিয়ে আসে, যা আমার পথ চলতে সাহায্য করে।

এই দূরত্ব আর নৈকট্যের দোলায় আমার মন বারবার আন্দোলিত হয়। একদিকে তোমার দূরে থাকার কষ্ট, অন্যদিকে তোমার কাছে থাকার আনন্দ। আমার একটাই চাওয়া, তুমি যেন আমার মনের এই অব্যক্ত বেদনা অনুভব করো। দূরে থেকেও যেন তোমার হৃদয়ের তারে আমার সুর বাজে, আর কাছে এলে তো কথাই নেই ভালোবাসার এক অনাবিল স্রোতে ভেসে যাই আমি। আমার বিশ্বাস, একদিন এই দূরত্বের কষ্ট ঘুচে যাবে এবং আমরা সবসময় কাছাকাছি থাকব, ভালোবাসার উষ্ণতায় আবদ্ধ হয়ে।

Saturday, May 3, 2025

বাংলাদেশে নারীর অবাধ চলাচল, স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের অপরিহার্যতা

 

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এই অগ্রযাত্রায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে নারীর অবাধ চলাচল, স্বাধীনতা এবং সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি। কোনো সমাজই তার অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদ রেখে সামগ্রিক উন্নতি লাভ করতে পারে না।

সংবিধানের ২৮(১) ও ২৮(২) অনুচ্ছেদে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আজও বাংলাদেশের নারীরা নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সম্পত্তির অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং জীবনে তাদের অবাধ চলাচল প্রায়শই সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নানা বাধার সম্মুখীন হয়। এই পরিস্থিতি নারীর ব্যক্তিগত বিকাশকে যেমন ব্যাহত করে, তেমনি জাতীয় উন্নয়নের ধারাকেও মন্থর করে দেয়।

নারীর অবাধ চলাচল ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মস্থল বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় স্থানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নারীর কোনো প্রকার ভয় বা বাধার সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একইসাথে, পরিবার ও সমাজের পুরুষ সদস্যদের মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। নারীকে কেবল গৃহস্থালির কাজের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে, তাদের বাইরে জগৎ দেখার এবং নিজেদের সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে।

সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৈতৃক সম্পত্তি এবং অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রে নারীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা গেলে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে। এটি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়াবে এবং সমাজে তাদের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম ভিত্তি।

শুধু চলাচল বা সম্পদ নয়, সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খেলাধুলা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবাধ অংশগ্রহণ এবং পুরুষের সমান সুযোগ থাকা উচিত। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী তার স্থান করে নেবে, এটাই হওয়া উচিত সমাজের মূলনীতি।

নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার পথে বিদ্যমান আইনি ও সামাজিক বাধাগুলো দূর করতে হবে। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন এবং অন্যান্য সকল প্রকার বৈষম্যমূলক practices কঠোর হাতে দমন করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনকে আরও কার্যকর করতে হবে এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার, পরিবার, সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলাদেশে নারীর অবাধ চলাচল, স্বাধীনতা এবং সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আসুন, আমরা সকলে মিলে একটি এমন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি যেখানে বাংলাদেশের নারীরা নির্ভয়ে তাদের জীবন পরিচালনা করবে এবং জাতীয় উন্নয়নে সমান অংশীদার হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমেই আমরা একটি সত্যিকারের উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।

খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প: সমৃদ্ধির আড়ালে শ্রমিকদের দুর্দশা:

  বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো পোশাক শিল্প। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। বিশ্বজুড়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ...