২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিনে সাভারে অবস্থিত আট তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ে, যা মূলত বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা ধারণ করত। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হন এবং অসংখ্য মানুষ গুরুতরভাবে আহত হন, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ঘটনার দিন সকালে, শ্রমিকরা তাদের
কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই ভবনটিতে ফাটল দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং
শ্রমিকদের প্রতি হুমকির কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকট শব্দে পুরো ভবনটি ধসে পড়ে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এই
ভয়াবহ বিপর্যয় কেড়ে নেয় ১,১৩৪ জন নিরীহ পোশাক শ্রমিকের প্রাণ, যাদের অধিকাংশই
ছিলেন নারী। আহত হন প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব
বরণ করেন।
রানা প্লাজার ধসের পর পুরো
বাংলাদেশ জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। সাধারণ মানুষ, উদ্ধারকর্মী, সেনাবাহিনী এবং
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী দল দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং হতাহতদের উদ্ধারের জন্য
দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে এই উদ্ধার অভিযান,
যেখানে জীবিত ও মৃত শ্রমিকদের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হয়। এই সময় বহু
হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়, যেখানে স্বজনহারাদের আহাজারি আকাশ-বাতাস ভারী করে
তোলে।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী
প্রশ্ন ওঠে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো, যারা এই কারখানাগুলোতে তাদের পোশাক তৈরি
করত, তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এর ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের
কর্মপরিবেশের উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও বর্তমান
পরিস্থিতি:
রানা প্লাজা ধসের পর দীর্ঘ সময়
অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু এই দুর্ঘটনার ক্ষত আজও শুকায়নি। নিহত শ্রমিকদের পরিবার আজও
তাদের প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন। আহত শ্রমিকদের অনেকেই শারীরিক ও
মানসিক trauma
নিয়ে কঠিন জীবন যাপন করছেন।
এই ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাক
শিল্পে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং অন্যান্য
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে কারখানাগুলোর নিরাপত্তা মান উন্নয়নের জন্য
বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ
(Accord on Fire and Building Safety in Bangladesh) এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ
ওয়ার্কার সেফটি (Alliance for Bangladesh Worker Safety)-এর মতো উদ্যোগগুলো
কারখানাগুলোর কাঠামো, অগ্নি নিরাপত্তা এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা পরিদর্শনের কাজ
করেছে। এর ফলে অনেক কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে।
তবে, এখনও অনেক ক্ষেত্রে উন্নতির
সুযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা এবং অন্যান্য অধিকার এখনও
সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানা এখনও নিরাপত্তা
ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও অনেক শ্রমিক এবং তাদের
পরিবার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বর্তমানে, রানা প্লাজার
জায়গাটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা এই মর্মান্তিক
ঘটনার শিকার হওয়া শ্রমিকদের প্রতি উৎসর্গীকৃত হবে এবং ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা
ও শ্রমিক অধিকারের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেবে।
রানা প্লাজার ঘটনা কেবল একটি
দুর্ঘটনা ছিল না, এটি ছিল আমাদের সমাজের দুর্বলতা এবং শ্রমিকদের প্রতি অবহেলার এক
নির্মম দৃষ্টান্ত। এই ঘটনার পর অনেক পরিবর্তন এলেও, শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ
এবং তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই
বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করাই হবে নিহত
শ্রমিকদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
KM Mintu
No comments:
Post a Comment