বাংলাদেশের
গার্মেন্টস শিল্প, যে খাত আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে পরিচিত, সেই শিল্প
আজ শ্রমিকের চোখের জল, ঘাম আর রক্তে ভিজে উঠছে। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের
রপ্তানি হয়, সেইখানেই শ্রমিকের জীবন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে সস্তা।
গাজীপুরের
দুটি মর্মান্তিক ঘটনা বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের বর্তমান নাজুক অবস্থা এবং
প্রতিনিয়ত তাদের মুখোমুখি হওয়া অমানবিকতার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। গত ২৮
জুন ২০২৫, গাজীপুরের কোনাবাড়িতে গ্রিনল্যান্ড গার্মেন্টস লিমিটেড ফ্যাক্টরিতে হৃদয় নামের এক শ্রমিককে চুরির অপবাদে
পিটিয়ে হত্যা করা হয়। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শুকতার বাইদ গ্রামের আবুল
কালামের ছেলে হৃদয় ওই কারখানায় মেকানিক্যাল মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন।
এর আগে, গত ২
জুন ২০২৫, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ধনুয়া নতুন বাজার এলাকায় ডিবিএল গ্রুপের
জিন্নাত নিটওয়্যার পোশাক কারখানার শ্রমিক জাকির হোসেন লেবেল লাগাতে ভুল করায় তাকে সবার সামনে কান ধরে উঠবস
করিয়ে অপমান করা হয়। এই চরম অপমান সইতে না পেরে জাকির কারখানার আটতলা ভবন থেকে
লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এই দুটি ঘটনা
কেবল ব্যতিক্রম নয় বরং প্রতিদিনকার নীরব, অজানা অসংখ্য নির্যাতনের প্রতীক।
শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন ভয়,
লাঞ্ছনা, মানসিক চাপে, এবং সবকিছুর ওপরে রয়েছে চাকরি হারানোর আতঙ্ক।
প্রডাকশনের চাপ, ন্যায্য মজুরির অভাব, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপত্তার ঘাটতি সব মিলে
শ্রমিকেরা যেন এক অন্ধকার গর্তে বন্দী।
সরকার ক্ষমতায়
আসার সময় বলেছিল, শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন হবে। বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা।
এই সরকারের শাসনামলে গুলি করে মারা হয়েছে তিনজন
শ্রমিককে, হাজার হাজার শ্রমিক
চাকরি হারিয়েছেন, এবং মিথ্যা
মামলায় জর্জরিত হয়েছেন আরও অনেকে। অথচ এই শিল্প দিয়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক
মুদ্রা অর্জন করছে। কিন্তু শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না ন্যায্য সম্মান, ন্যায্য অধিকার,
ন্যায্য জীবন।
আমরা কী তাহলে
শুধুই উৎপাদনের যন্ত্র তৈরি করেছি —
মানুষ নয়? গাজীপুরের হৃদয় আর জাকিরের মৃত্যু কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেবে না? এখনই
সময় শ্রমিককে মানুষ ভাবার,
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার,
শ্রমিকের সম্মান রক্ষার। না হলে
গার্মেন্টস শিল্প একদিন নিজের ভিতরেই ধসে পড়বে, কারণ কোনো খাতে রক্তের দাগ বেশিদিন
ঢাকা যায় না।
এই দুটি ঘটনা
শ্রমিকদের প্রতিবাদের মাধ্যমেই জনসম্মুখে এসেছে। তবে, এমন ঘটনা প্রায় নিয়মিত
ঘটলেও অধিকাংশই আড়ালেই থেকে যায়। পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদনের চাপ, চাকরি
হারানোর ভয় এবং শ্রমিকদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ তাদের মানসিক যন্ত্রণার কারণ
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার পোশাক শ্রমিক
শ্রমিকদের
বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলেও শ্রমিকদের বঞ্চনা
ও বৈষম্য আরও বেড়েছে। সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিন জন শ্রমিককে গুলি করে
হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং হাজার হাজার
শ্রমিকের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এসব ঘটনা
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অন্ধকার দিককে উন্মোচন করে। শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির
মেরুদণ্ড হলেও তাদের জীবন ও সম্মান প্রায়শই অবহেলিত থেকে যায়। এ ধরনের ঘটনা
প্রমাণ করে যে, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের জন্য একটি নিরাপদ ও মানবিক
কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে।
খাইরুল মামুন
মিন্টু
আইন বিষয়ক
সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র